মসজিদে নামিরায় ৬০ হাজার মুসল্লির লাব্বাইক ধ্বনি
করোনামুক্ত পৃথিবীর আকুতিতে পবিত্র হজ পালিত
মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)-এর মিলনের স্মৃতিবিজড়িত আরাফাতের ময়দানে ৬০ হাজারের বেশি হাজীর উপস্থিতিতে সোমবার এবারের সীমিত পরিসরে পবিত্র হজ পালিত হচ্ছে। এদিন আরাফাতে অবস্থান করে হাজীরা তাদের জীবনের সব গুনাহের ক্ষমার জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে কায়মনোবাক্যে মোনাজাত করছেন। আজ সূর্যাস্ত অবধি তারা আরাফাতের সীমানায় অবস্থান করবেন।
দুপুরে যোহর ও আসর নামাজ এক আজান ও দুই ইকামাতে কসর করে আদায় করা হয়। হজ খুতবায় পবিত্র মক্কার মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতীব শায়খ বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা মহামারি সম্পর্কে মহানবী (সা.) এর শিক্ষা অনুসরণ করার জন্য সমবেতদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, নবী করিম (সা.) লোকদের এমন একটি জায়গায় না যাওয়ার জন্য বলেছিলেন যেখানে মহামারি রয়েছে।
করানা মহামারির মধ্যে দ্বিতীয় দফা হজে আগত মুসল্লিদের উদ্দেশে শায়খ বান্দার বালিলা বলেন, ‘মহানবী (সা.) বলেছেন, মহামারি যে অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে সেখানকার লোকদের বাইরে যাওয়া উচিত নয় এবং অন্যান্য অঞ্চলের লোকদের উপদ্রুত এলাকায় না যাওয়া উচিত’।
খুতবায় শায়খ বান্দার মুসলমানদেরকে সমতা প্রতিষ্ঠা, একে অপরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ দূর করার আহ্বান জানান। তিনি আল্লাহর দোহাই দিয়ে সবাইকে একে অপরকে ক্ষমা করতে বলেছেন। গ্র্যান্ড মসজিদের ইমাম বলেন যে, হজ হ’ল ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ এবং যারা হজে আসতে সক্ষম তাদের এটি সম্পন্ন করার জন্য স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা আহ্বান জানিয়েছেন।
সোমবার জাবালে রহমতের পাদদেশে আরাফাত ময়দানে ৬০ হাজার হাজী তাদের জীবনে কৃত পাপের ক্ষমার জন্য জমায়েত হয়েছেন এবং তারা শান্তি ও করোনামুক্ত একটি পৃথিবীর জন্য প্রার্থনা করছেন।
সউদী আরবের মক্কা এবং মদীনায় ইসলামের পবিত্রতম স্থানগুলো বিদেশ থেকে আসা যিয়ারতকারীদের জন্য দ্বিতীয় বছরের মত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে এবং করোনাভাইরাস ও এর নতুন নতুন রূপ থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ শর্তে সউদী আরবে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মাত্র ৬০ হাজার সউদী নাগরিক এবং বিভিন্ন দেশের বাসিন্দা, যারা সম্পূর্ণরূপে টিকা নিয়েছেন বা করোনা থেকে সেরে উঠেছেন এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগেন না, তাদের এ বছর হজের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
ফিলিস্তিনের হজযাত্রী উম আহমেদ বলেন, ‘এটি একটি অবর্ণনীয় অনুভ‚তি যে, আমি কয়েক হাজার লোকের মধ্যে হজে যোগদানের জন্য নির্বাচিত হয়েছি। সমগ্র বিশ্বের করোনাভাইরাসের মধ্য দিয়ে যেসব জটিল সময় অতিবাহিত হয়েছে, তার অবসান করার জন্য আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা করছি’। উম আহমদ সউদী রাজধানী রিয়াদে বাস করেন এবং তিনি বলেন যে, তিনি ভাইরাসে পরিবারের চার সদস্যকে হারিয়েছেন।
পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ২০ লক্ষাধিক মুসলিম হজযাত্রী উষ্ণ শহর মক্কার অদূরে আরাফাতের তাঁবুতে প্রচন্ড উত্তাপের মধ্যে একে অপরের কাছাকাছি বসে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে সাদা-সবুজ ছাতা মাথায় দিয়ে হজ পালন করতেন। এ বছর সাদা পোশাক পরিহিত হজযাত্রীদের আরাফাত পাহাড়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং মাস্ক পরতে হয়েছে।তার পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন।
সিরিয়ার হজযাত্রী মাহের বরুদি বলছিলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলার কাছে আমাদের প্রথম প্রার্থনা হ’ল, তিনি যেন এই মহামারি, এই অভিশাপ পৃথিবী থেকে তুলে নেন যাতে পরের বছরগুলোতে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মুসলিমরা ব্যাপক হারে হজে যোগ দিতে সক্ষম হন এবং লাখ লাখ মুসল্লি এসব পবিত্র স্থানে আল্লাহর মহত্ব বর্ণনায় মুখরিত করে তুলতে পারেন।
আজ সূর্য অস্ত যাবার পর মাগরিব আদায় না করেই রওনা করবেন মুজদালিফার উদ্দেশে। এ বছর সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত গাড়ির ব্যবস্থা থাকায় হয়তো কাউকে পায়ে হেঁটে মুজদালিফায় যেতে হবে না। তবে যারা স্বেচ্ছায় হেঁটে যেতে চান তাদের কথা ভিন্ন। আজ মুজদালিফায় পৌঁছে হজযাত্রীরা মাগরিব ও এশা আদায় এবং খোলা ময়দানে রাত্রী যাপন করবেন।
আগামীকাল সূর্যোদয়ের পর মিনায় গিয়ে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাবার আগেই বড় জামরায় ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। সরকার জীবাণুমুক্ত কঙ্কর প্রত্যেক হজযাত্রীকে উপহার দেয়ায় তাদের মুজদালিফা থেকে সংগ্রহ করতে হবে না।
হজযাত্রীরা ছাড়া বাকি সবাই আগামীকাল ঈদুল আজহা উদযাপন করবেন। হজযাত্রীদের বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা ছাড়াও কাবায় গিয়ে তাওয়াফে যিয়ারাহ তথা ফরজ তাওয়াফ আদায় করতে হবে। এদিন না করে ফরয তাওয়াফ ১১ বা ১২ যিলহজও করা যায়। এদিনের আরো একটি কাজ হল মাথা মুÐন বা চুল ছোট করা। এরপর হজযাত্রীরা ইহরাম ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাক পরবেন।
১১ ও ১২ যিলহজ হজযাত্রীরা সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাবার পর তিনটি জামারাত তথা জামরাতুল উলা, জামরাতুল উসত্বা ও জামরাতুল আকাবা বা বড় জামরাতে প্রতিদিন ৭টি করে ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। এরপর যারা সংক্ষেপ করতে চান তারা ১২ যিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপের পর সূর্যাস্তের পূর্বেই মিনা ত্যাগ করবেন। মিনায় সূর্যাস্ত হয়ে গেলে ১৩ যিলহজ ৩টি জামরাতে আরো ৭টি করে ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করে হজ সম্পন্ন করবেন। পরিশেষে মক্কা ত্যাগের সময় বিদায়ী তাওয়াফ করবেন।
করোনাভাইরাস বিস্তারের শঙ্কা রোধে এবার হজযাত্রীদের সংখ্যা ৬০ হাজারে সীমিত করে দেয়া হয়েছে। অনলাইনে সাড়ে ৫ লাখের বেশি আবেদন থেকে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত হন তারা। সবাইকে দেয়া হয় দুই ডোজের ভ্যাকসিন। গত বছর সউদীতে অবস্থানকারী বিভিন্ন দেশের ১০ হাজার মুসল্লি হজ আদায়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তথা সামাজিক দূরত্ব বজায়সহ স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা ব্যবস্থার পাশাপাশি তা মানা নিশ্চিত করতে হজযাত্রীদের পাশাপাশি অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম এবং সক্ষম মুসলমানদের জন্য জীবদ্দশায় কমপক্ষে একবার ফরজ। এটি বিশ্বে মুসলিমদের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ। ২০১৯ সালে বিশ্বের প্রায় ২৫ লাখ মুসলিম এতে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে দু’বছর ধরে সীমিত পরিসরে হজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এই বছর হজ পালনের জন্য বিশেষভাবে নির্বাচিত হজযাত্রীরা চলমান করোনভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিতে পবিত্র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত। এ বছর হজের জন্য নির্বাচিতদের বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে হয়েছে, যার মধ্যে ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মোডার্না বা জনসন ও জনসন ভ্যাকসিনের মধ্যে যে একটি গ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল।
গত পাঁচ বছরে যারা হজ পালন করেননি এ বছর সেসব ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এছাড়া হজ করেননি ৫০ বছর বয়সী বা তার চেয়ে বেশি বয়সী ব্যক্তিদেরও অগ্রাধিকার দেয়া হয় এ বছর। এমনকি এবারই প্রথমবারের মতো পুরুষ অভিভাবক ছাড়া হজের নিবন্ধন করার সুযোগ পেয়েছেন সউদী নারীরা।