‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা তালেবানের
আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরেছে তালেবান
আফগান ছেড়ে পালিয়েছেন আশরাফ গনি
আফগানিস্তানে ২০ বছর পর ফের ক্ষমতায় ফিরেছে তালেবান। এক সমঝোতা বৈঠকের পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। তার সঙ্গে দেশ ছেড়েছেন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাও। তিনি তাজিকিস্তানের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছেন বলে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে। স্টাফসহ আশরাফ গনি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ত্যাগের পর তা দখলে নিয়েছে তালেবান। সরকারের প্রতিনিধি দল ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে সোমবার কাতারের রাজধানী দোহায় যাচ্ছেন। সেখানেই এক চুক্তির বলে দেশটি থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা।
ব্রিটিশ সরকার আফগানিস্তানে অবস্থানরত ব্রিটিশ হাই-কমিশনারকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য কাবুলে অবস্থিত ব্রিটিশ সেনাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। তালেবান যোদ্ধারা আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে প্রবেশের পর ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেছে। তালেবানের রাজনৈতিক মুখপাত্র সুহাইল শাহিন এক ঘোষণায় পুরো আফগানিস্তানে ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ইসলামী ইমারত আফগানিস্তানের দরজা ওই ব্যক্তিদের জন্যও উন্মুক্ত থাকবে যারা আমাদের বিরুদ্ধে হামলায় সহযোগিতা করেছে। কাবুলে লুটপাট ঠেকাতে তালেবানদের শহরে প্রবেশের আদেশ দেয়া হয়েছে। তাদের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ একথা বলেছেন।
ঝটিকা অভিযানে গতকাল রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে তালেবান। আগেই জালালাবাদ এবং মাজার-ই-শরিফের দখল নিয়েছিল তারা। ইতোমধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে কাবুল পুলিস। তালেবান যোদ্ধারা কাবুলে প্রবেশ করতেই পদত্যাগ করেছেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। এখন তালেবানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। আফগানিস্তানের স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, শীর্ষ নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারদারের নেতৃত্বে তালেবানে নেতারা আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্যালেসে গিয়ে সরকারের কাছ থেকে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের সাথে কাতার এবং আমেরিকার কূটনীতিবিদরাও যান সেখানে।
সরকারের একজন মন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কাবুলে হামলা হবে না, এ শর্তে তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। স্থানীয় টোলো টিভিতে প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় এ তথ্য জানিয়েছেন দেশটির ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সাত্তার মিরজাকওয়াল।
রাজধানীতে প্রবেশের সময় তালেবান যোদ্ধাদের তেমন কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি বলে কাবুল থেকে জানিয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক ইয়ালদা হাকিম। তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে সেখানে কাজ করছেন। আফগানিস্তানের নিরাপত্তাকর্মী ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে বলেও জানানো হয়েছে।
তালেবানের এক নেতার বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, রাজধানী শহরটিতে যোদ্ধাদের সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে বলেছে তালেবান। কেউ শহরটি ত্যাগ করতে চাইলে, তাদের এ সুযোগ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাহিনীটি। এছাড়া নারীদের নিরাপদে অবস্থান করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র তাদের কূটনীতিকদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নিয়েছে। কাবুল বিমানবন্দর ও দূতাবাস সুরক্ষিত করতে নতুন করে সেনাও পাঠিয়েছে তারা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অল্প কয়েকজনের একটি ব্যাচ আফগানিস্তান ছেড়েছে, কর্মীদের বেশিরভাগই দেশটি ছাড়ার জন্য প্রস্তুত। তবে দূতাবাসের কার্যক্রম এখনও পুরোদমে চলছে।
তালেবান বাহিনী কাবুলে প্রবেশের সময় প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আফগানিস্তানের টলোনিউজ নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে একথা জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গনির ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাও তার সঙ্গে দেশ ছেড়েছেন। আফগান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মন্তব্য জানতে চাইলে প্রেসিডেন্টের কার্যালয় বলেছে, নিরাপত্তার কারণে আশরাফ গনির গতিবিধি সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। তবে তিনি তাজিকিস্তানের উদ্দেশে দেশত্যাগ করেছেন বলে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স রোববার জানিয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিসমিল্লাহ মোহাম্মদী আগের দিন বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট দেশের সঙ্কট সমাধানের ক্ষমতা রাজনৈতিক নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। টলোনিউজের খবর অনুযায়ী, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি প্রতিনিধি দল সোমবার দোহা যাবে।
তালেবানদের ঘোষণায় ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তারা দ্রুত ক্ষমতা গ্রহণের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী, কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশগুলো তাদের নাগরিকদের রাজধানী থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ছুটে এসেছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার সময় মিরজাকওয়াল বলেছিলেন যে কাবুল আক্রমণ করা হবে না এবং স্থানান্তর শান্তিপূর্ণভাবে হবে। তিনি বলেন, কাবুলের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিরাপত্তা বাহিনীর। তালেবান উত্তরাঞ্চলের মাজার-ই-শরিফ এবং জালালাবাদের পূর্বাঞ্চলীয় শহর দখর করার পর গতকাল প্রেসিডেন্ট গনির সরকার সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অন্যান্য দখলকৃত শহরগুলোর মতো, সরকারী বাহিনী আত্মসমর্পণ বা পশ্চাদপসরণের পর ক্ষমতা দখল করে।
এদিকে আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয়ধ্বনি শুরু হয়েছে। আগামী দিনে তারাই দেশ পরিচালনা করবেন। এমন অবস্থায় আফগানিস্তান নিয়ে পরিকল্পনা জানিয়েছে তালেবান। এক সাক্ষাৎকারে তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহীন আগামী কয়দিন তারা কী কী করবেন সেটা জানিয়েছেন। তালেবানের এই নেতা বলেন, আগামী কয় দিনের মধ্যে প্রথমত, আমরা ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর চাই, দ্বিতীয়ত, মানুষ তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করবে, তৃতীয়ত যারা কাবুল সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে আমরা তাদের ওপর কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেব না। তালেবানের এই নেতা আরও বলেন, আমরা চাই সকল বিদেশি দূতাবাস তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালু রাখুক। ক‚টনীতিকদের কোনো ভয় নেই। সবাই পূর্বের মতো কাজ করবে। এ সময় তিনি বলেন, আশরাফ গনিসহ আফগানিস্তানের নেতাদের আমরা আমাদের সঙ্গে কাজ করার আহŸান জানাই। শাহীন তালেবানকে দেশ ও জনগণের সেবক বলে উল্লেখ করেন।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানাচ্ছে, তালেবানের দাপটে কাবুলের বাসিন্দাদের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল তা অনেকাংশে কেটে গেছে। সবাই যার যার বাড়িতে অবস্থান করছেন। রাস্তায় এখন তেমন কোনো যানবাহন দেখা যাচ্ছে না। তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন বলেছেন, তালেবান এখনো কাবুলে ঢোকেনি। তবে যোদ্ধাদের কাবুলের প্রবেশদ্বারগুলোতে থাকতে বলা হয়েছে। পরবর্তী পরিস্থিতি নির্ভর করছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে সরকারের সহযোগিতার ওপর। রাজধানী কাবুলের উপকণ্ঠে তালেবান যোদ্ধাদের দেখা যাওয়ার খবর পাওয়ার পর কাবুল ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিবিসির এক প্রতিনিধি বলছেন, কিছু সরকারি অফিস খালি করতে বলা হয়েছে এবং দোকানপাট বন্ধ। এর কোনো কারণ জানানো হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ১৮টি তালেবানের হাতে ছিল। কিন্তু এরপর কার্যত ঝড়ের গতিতে এগোতে শুরু করে তালেবান। একে একে হেরাত, আয়বাক, গজনি, কান্দাহার, তালিকান, কুন্দুজ দখল করে তারা। উত্তর দিক থেকে কাবুলের প্রবেশ পথ মাজার-ই-শরিফও একদিনেই দখল করে নেয় তালেবান। তারপর গতকাল সকালে দক্ষিণের জালালাবাদ দখল করে তারা। তালেবানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি মেনে এ বছর ৯ মার্চ থেকে সেনা সরাতে শুরু করে আমেরিকা। তার পর থেকেই ডালপালা মেলতে শুরু করে তালেবান। জুন মাসের শেষ দিকে সরাসরি আফগান বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বাধে তাদের। তাতে আফগান বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে এগোতে শুরু করে তালেবান। একের পর প্রদেশ তালেবানের দখলে চলে যাবার পর গোয়েন্দা রিপোর্ট উদ্ধৃত করে এক সপ্তাহেরও কম সময় আগে ৯০ দিনের মধ্যে দেশটি তালেবানের দখলে চলে যাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়। কিন্তু তার এক সপ্তাহের মধ্যেই আফগানিস্তানের দখল নিল তারা।
নারী অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাবে
তালেবানের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তারা নারীদের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাবেন। মুখপাত্রটি বলেন, নারীদেরকে একা বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হবে এবং তাদের শিক্ষা ও কাজের সুযোগও বহাল থাকবে। মনে করা হচ্ছে, তালেবানকে নিয়ে সারা বিশ্বে যে উদ্বেগ রয়েছে তা অবসানের জন্যই এ বিবৃতি।
কাবুলের কারাগার থেকে বন্দীদের মুক্তি
কাবুলের পুল-ই-চরখি কারাগার থেকে তালেবান বন্দীদের মুক্তি দেয়ার ছবির ফুটেজ অনলাইনে পোস্ট করেছে তালেবান সমর্থক একটি সংবাদ সংস্থা। এটি আফগানিস্তানের সর্ববৃহৎ কারাগার। রোববার আরো আগের দিকে তালেবান সৈন্যরা বাগরামে আমেরিকান সমারিক ঘাঁটির সেনা কারাগারের দখল নেয়। বাগরাম কারাগারে যে পাঁচ হাজার বন্দী ছিল তাদের মধ্যে ছিল তালেবান সদস্য, উগ্রপন্থী যোদ্ধা এবং ইসলামিক স্টেটের সদস্য।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকছে রাশিয়া
আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি জরুরি বৈঠক ডাকার পরিকল্পনা করছে। পররাষ্ট্র বিষয়ে রুশ সংসদের একজন মুখপাত্র বলেছেন মানবিক বিপর্যয় রোধ করা এখন খুবই জরুরি। ইইউর একজন মুখপাত্র বলেছেন যে, আফগানিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা এবং নারীর অধিকার মেনে চলা হচ্ছে কিনা তার ওপর নির্ভর করবে মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা হবে কিনা।
ভাটিকানে পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, একমাত্র আলোচনার মাধ্যমেই আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রিটিশ সংসদে গ্রীষ্মকালীন ছুটির মধ্যে এ সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য বুধবার সংসদের জরুরি অধিবেশন ডেকেছেন। সূত্র : এপি, এএফপি, বিবিসি, আল-জাজিরা।