পঞ্চাশে বাংলাদেশ
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্ণ হলো। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী। একটি জাতির জন্য এই বয়স তেমন কিছু নয়; তবে দেশ হিসাবে ৫০ বছর সময় একেবারে কম নয়। চীন, ভিয়েতনাম ৫০ বছরে অনেকদূর এগিয়েছে; বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছি। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে প্রাপ্তির হিসেবে গড়মিল থাকলেও অর্জন কম হয়নি। আমাদের প্রাপ্তির তালিকা বেশ বড়, সমৃদ্ধ, গৌরবময়। এ সময়ে আর্থ সামাজিক উন্নতি এবং মানুষের যাপিত জীবনে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। শুধু বার্ষিক অর্থ বছরের বাজেট বেড়েছে ৭৬৭ গুণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ পেয়েছি আর তার কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে নিয়ে গেছেন উন্নয়নের মহাসড়কে।
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের উদয়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি।’ সেই তলাবিহীন ঝুড়ি ৫০ বছরে আধুনিক কৃষি, তৈরি পোশাক, দারিদ্র্যতা দূরীকরণ, অর্থনীতি, রেমিট্যান্স, গড় আয়ু, আমদানি, রফতানি, রিজার্ভ, মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, নারী শিক্ষা, কলকারখানায় উৎপাদনসহ অনেক সূচকে এখন বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। সামাজিক অনেক সূচকে বাংলাদেশ পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। কীভাবে বাংলাদেশের এই উন্নতি ঘটেছে তার কারণ পশ্চিমা এবং ভারতীয় মিডিয়াগুলো খুঁজে বেড়াচ্ছে।
বিজয়ের ৫০ বছরে আমরা কতটুকু এগিয়েছি? ব্যর্থতাই বা কোনখানে? এই ৫০ বছরে বাংলাদেশ নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। এক সময় বৈদেশিক অর্থ তথা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির অর্থ ছাড়া উন্নয়ন কর্মকান্ড কল্পনাও করা যেত না। এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ পর্যায়ে। সারাদেশের হাজার হাজার মাইলের মহাসড়ক নির্মাণ-সংস্কার, মেট্রোরেল, ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, রূপপুর পারমাণবিক প্ল্যান্ট, ওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট, রাস্তাঘাট নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবন, রেল উন্নয়ন, নৌপথ তৈরি, নতুন রাস্তা নির্মাণ ও পুরানো রাস্তা সংস্কার, নাগরিকদের জন্য প্রায় শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করেছে। এখন রাজধানী ঢাকার মতোই গ্রামাঞ্চল এমনকি চরাঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়া যায়। মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এটা সম্ভব হয়েছে।
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে ইতিহাসের পেছনে তাকালে কি দেখি? ’৪৭ সালের দেশ ভাগের পর ২৩ বছর বৈষম্যে জর্জরিত হয় পূর্ব পাকিস্তান নামের ভুখন্ড। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ ২৩ বছর কঠিন ত্যাগ স্বীকার করে প্রাণপণ সাহসী সংগ্রামের ফসল ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর সেদিনের যুবনেতা শেখ মুজিব বুঝে যান পাকিস্তানের অধীনে থাকলে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি মিলবে না। এ জন্য ১৯৬৬ সালেই তিনি স্বাধীনতার চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করেন। তার নামেই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। এখন তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে নিম্নআয়ের দেশের তালিকা থেকে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উঠে আসছে। এক সময়ের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন আপন দক্ষতায় স্বনির্ভর উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় ভূষিত। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসাধারণ নেতৃত্বে গত একযুগে বদলে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন এক দ্রুত উন্নয়নশীল বিকাশমান অর্থনীতির রাষ্ট্র।
১৯৭১ সালে ৯ মাস জনযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত রাষ্ট্র। মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। এই ৫০ বছরে সেই দারিদ্র্যতা নেমে এসেছে ২০ শতাংশের নিচে। এটা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল। ১৯৭১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সামষ্টিক ও ব্যাষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথম (১৯৭২-৭৩) অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা। অথচ বর্তমান (২০২০-২১) অর্থ বছরে বাজেট ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি। ১৯৭০-এ সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার। বর্তমানে ১৭ কোটিরও বেশি মানুুষের মাথাপিছু গড় আয় ২৫০০ ডলারের বেশি।
এটা ঠিক ’৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জনযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা ছিল। সাম্যের দেখা নেই। পাকিস্তানের ২২ ধনী পরিবার ছিল। এখন ২২ হাজার পরিবার অর্থবিত্তে ধনী হয়েছেন। এদের মধ্যে যারা অসাধু এবং দুর্নীতি করেছেন তারা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। এতে ধনী-গরিব বৈষম্য বেড়ে গেছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যে দেশের যখন বিপুল সংখ্যক মানুষ গরিব হয়েছে; তখনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে দেখা গেছে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে গেছে। এখন মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাওয়ার পথে। ন্যায়বিচার পাওয়া যেন কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যায়ভাবে একে-অন্যের ওপর প্রতিনিয়ত করা হচ্ছে অবিচার। ভোটের প্রতি জনগণের অনিহা। গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। অথচ রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সামাজিক সুশাসন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এসবের স্বাদ আস্বাদনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ পাকিস্তান শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’ প্রতিপাদ্যে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিচালনায় থাকবে সুবর্ণ জয়ন্তী ও মুজিববর্ষের শপথ। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে জাতীয় পতাকা হাতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। শপথগ্রহণ শেষে আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্ব করবেন। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। সম্মানীয় অতিথির বক্তব্য রাখবেন ভারতের প্রেসিডেন্ট শ্রী রামনাথ কোবিন্দ।
জাতীয় পর্যায়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, সূর্যোদয়ের সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ সূর্য সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
বিজয়ের এ ৫০ বছর উদযাপনের মধ্যদিয়ে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হোক সুশাসন, গণতন্ত্র, ও সামাজিক ন্যায় বিচার। যাতে সাধারণ নাগরিক মাথা উঁচু করে বলতে পারে স্বাধীনতা অর্জনের মৌলিক প্রত্যাশা পূরণে আমাদের বিসর্জন ব্যর্থ হয়নি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেটা সম্ভব।