ধর্মীয় আক্রোশের লক্ষ্যবস্ত ভারতে মুসলিম নারীরা
গত ১১ ফেব্রুয়ারী ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দেশে চলমান হিজাব বিতর্কের উপর একটি পিটিশন শুনতে অস্বীকার করেছে, এমনকি কর্ণাটকের হাইকোর্টে মামলার শুনানি চলা সত্ত্বেও। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তটি একটি প্রত্যাশার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে পারে যে, বিতর্কটি কর্ণাটক রাজ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, যেখানে এটি শুরু হয়েছিল। ভারতের প্রধান বিচারপতি এনভি রামানার নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ শুনানির তারিখ উল্লেখ করতে অস্বীকার করে মন্তব্য করেন, ‘এসব বিষয় বড় মাত্রায় ছড়িয়ে দেবেন না; আমরাও দেখছি। আমরাও জানি রাজ্যে কী ঘটছে। আপনি চিন্তা করুন (উচিত) যে, এই জাতীয় বিষয়গুলিকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা ঠিক হবে কিনা।’
তবে, ভারতের প্রধান বিচারপতির প্রত্যাশা সফল হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ হিজাব পরা মুসলিম মহিলাদের নিয়ে বিরোধ অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরার অনুমতি বা নিষেধাজ্ঞা ঘিরে বিতর্ক আইনি সমস্যার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এখানে ধর্ম, লিঙ্গ বৈষম্য এবং ধর্মনিরপেক্ষতার দিক জড়িত। কিন্তু মুসলিমরাই কি একমাত্র ধর্মীয় গোষ্ঠী যেখানে নারীরা জনসমক্ষে ভিন্নভাবে পোশাক পরেন বা মাথা ঢেকে রাখেন? পিউ সমীক্ষার একটি প্রতিবেদনের ফলাফলগুলি এমন সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে না। এতে দেখা গেছে যে, ভারতের প্রায় ৬১ শতাংশ মহিলা তাদের বাড়ির বাইরে বের হলে তাদের মাথা ঢেকে রাখেন। যদিও এই অনুশীলনটি মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত (৮৯ শতাংশ), শিখদের মধ্যেও এর হার প্রায় একই (৮৬ শতাংশ) এবং হিন্দুদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি (৫৯ শতাংশ)।
ভারতের মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক এবং শিক্ষা পরিস্থিতির উপর ২০০৬ সালের সাকার কমিটির রিপোর্টে দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সাধারণত মহিলারা সম্প্রদায়ের পরিচয়ের মশালবাহী। সুতরাং, যখন সম্প্রদায়ের পরিচয় অবরুদ্ধ হতে দেখা যায়, তখন এটি স্বাভাবিকভাবেই নারীদের নাটকীয়ভাবে প্রভাবিত করে। মহিলারা, কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও কখনও সম্প্রদায়ের চাপের কারণে তাদের ব্যক্তিত্ব এবং আচরণে সম্প্রদায়িক পরিচয়ের দৃশ্যমান চিহ্নিতগুলি বহন করে থাকেন। তাদের জীবন, নৈতিকতা, এবং জনসমক্ষে চলাফেরা ক্রমাগত নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণের অধীন। ‘প্রকাশ্য’ একটি লিঙ্গ-ভিত্তিক ভয়, যার অভিজ্ঞতা কিছু মাত্রায় সমস্ত মহিলারাই পেয়ে থাকেন। তবে এটি মুসলিম মহিলাদের ক্ষেত্রে বহুগুণ বেশি।
২০১৫-১৬ জাতীয় পরিবার এবং স্বাস্থ্য সমীক্ষা দেখায় যে ভারতে চলাফেরার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে মুসলিম মহিলাদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। তাই হিজাবের নিষেধাজ্ঞার কারণে বৃহদাংশে মুসলিম মহিলাদের যে কোন বৃহৎ আকারের প্রত্যাহার অন্যদের তুলনায় তাদের শিক্ষাগত ব্যবধান আরও শোচনীয় করে তুলবে। ভারতের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের ২০১৭-১৮ সালের শিক্ষার সংক্রান্ত সমীক্ষা দেখা গেছে যে, শিক্ষায় অংশগ্রহণকারী মুসলিম মহিলাদের মধ্যে ১৫-২০ বছর বয়সীদের সংখ্যা (পাঁচ বছর বয়সী গোষ্ঠীর তুলনায়) সামগ্রিক জনসংখ্যার তুলনায় দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সী মুসলিম মহিলাদের মধ্যে যারা এখনও শিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের তুলনায় ০ দশমিক ৫৪ গুণ, যেখানে সামগ্রিক জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ০ দশমিক ৬৬ গুণ।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, নারীদের কী পরা উচিত বা পরা উচিত নয়, তা নির্ধারণ করার প্রবণতা সারা বিশ্ব জুড়েই দেখা যাচ্ছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত প্রায়শই নারীরা, যারা অনেক দেশে নিন্দার সম্মুখীন হয় কারণ তাদের পোশাককে খুব বেশি ধার্মিক বা যথেষ্ট ধার্মিক নয় বলে মনে করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞাগুলি প্রায়শই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা সামাজিক হয়রানির রূপ নেয়, তবে কখনও কখনও সরকারী পদক্ষেপগুলিকেও জড়িত করে। -হিন্দুস্তান টাইম্স।