একুশের চেতনা ও আমাদের সংষ্কৃতি

এনামুল হক: একুশ আমার অহঙ্কার। একুশ মানে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা, একুশ মানে বিদ্রোহের দাবানল, একুশ মানে অধিকার আদায়ের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, একুশ মানে জালিমের শোষনের বিরুদ্ধে অবিচল দ্রোহ। একুশে ফেব্রুয়ারির সাথে আবহমান বাংলার হাজার বছরের সংষ্কৃতির ঐতিহ্য অতপ্রোত ভাবে জড়িত।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানের উপর শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্মম শোষণ। ধীরে ধীরে পশ্চিম-পাকিস্তানের শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলার জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভ জমতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা দেন-‘Urdu and only urdu shall be the state language of Pakistan.’ পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একই কথা বললে ছাত্রদের মধ্য থেকে , ‘No, No, It can’t be.’ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়ে ওঠে।
১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনও একই রকম ঘোষণা দেন। এতে সারাদেশে ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ফুসে উঠে বাংলার ছাত্র জনতা।
৪ ফেব্রুারি সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পালিত হয় ‘ধর্মঘট’। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে ঢাকায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের হয়। রাজপথে মিলিত হয় হাজার হাজার ছাত্র-জনতর স্রোত।
এই মিছিলে সরকার গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউরসহ আরো অনেকেই শহিদ হন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে যাওয়া এই ইতিহাস পৃথিবীর মানুষ চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। দুনিয়ার মাঝে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য আত্মদানকারী একমাত্র জাতী আমরাই।
শহিদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে পালিত হয়।
সংস্কৃতি মানুষের জীবনাচরণেরই অপর নাম। মানুষের সমস্ত আঁচার-আচরণের সমষ্টিই হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে বিচিত্রভাবে বাঁচা।’ ম্যাথু আর্নল্ডের ভাষায়, ‘সংস্কৃতি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় বিশ্বের সর্বোত্তম জিনিসগুলোর সঙ্গে এবং সে সঙ্গে মানুষের গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গেও।’ কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমান বলেছেন, ‘সংস্কৃতি জীবনকে মোকাবিলার চেতনা।’ মানুষের বিশ্বাস, জ্ঞান, ভাষা, রুচি, সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, পোশাক, পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, মূল্যবোধ, নিয়ম, নীতি, সংস্কার প্রভৃতি সংস্কৃতিরই অন্তর্ভুক্ত।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একুশের চেতনা ধারণ করার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। একুশের চেতনা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমাদের সংস্কৃতিকে উন্নতভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একুশের চেতনা অপরিহার্য। কেননা, সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে তা ভিন্নরূপে আমাদেরকে নির্মাণ করবে, সংস্কৃতিকে নবআঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা করবে।
সমাজ বাস্তবতায় আধুনিক জীবনাচারনে একুশের চেতনা আজ অনেকাংশেই বদলে গেছে। একুশের দ্রোহ, একুশের বিপ্লবী চেতনা ধারন থেকে নতুন প্রজন্ম দূরে সরে যাচ্ছেন। অধিকার আদায়ের বিপ্লবের চাষীরা আজ একুশের চেতনা ভুলে নতুন চেতনায় বিভোর।
ফিরে আসুক দ্রোহ, শহীদ সালাম বরকত রফিক জব্বারের আত্মত্যাগের একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে গড়ে উঠুক আগামীর বাংলাদেশ। -লেখক- সাংবাদিক

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button