৩০ বছর আগে যা ছিল তা আর নেই : মিনা আজ একটি সর্বাধুনিক শহর
সারা বছর বিরান পড়ে থাকে তাঁবুর শহর মিনা। কিন্তু প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে হজ্জের পাঁচ দিনে। মক্কার বাইরে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মিনা হচ্ছে সেই শহর যেখানে পুত্রকে কুরবানি দেয়ার আল্লাহর নির্দেশ পালনের পূর্বে হযরত ইব্রাহিম (আ.) সারারাত কাটিয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) প্রস্তুত হন ইসমাইলকে কুরবানি দেয়ার জন্য। এমন সময় আল্লাহ তাঁকে আদেশ দেন পুত্রের পরিবর্তে একটি মেষ তিনি যেন কুরবানি দেন। দুনিয়াজুড়ে মুসলমান সম্প্রদায় নবী ইব্রাহিমের (আ.) সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের স্মরণে এদিন মেষ, গরু ও উট জবেহ করেন গরিব জনগণের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার জন্য।
উপত্যকায় অবস্থিত একটি ছোট শহর হচ্ছে মিনা। যতোদূর চোখ যায়, দেখা যায়, খালি জায়গাগুলো ভরে রয়েছে তাঁবুতে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে সেজে উঠেছে সারি সারি তাঁবু। সর্বব্যাপী তাঁবুর সমাহারের কারণে মিনাকে বলা হয় তাঁবুর শহর।
পেছনের দু’বছরে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে শহরটির। সরকার শত শত কোটি রিয়াল ব্যয় করেছে শহরটির অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনায়। হজ্বের ক্রিয়ানুষ্ঠান পালনে হজযাত্রীরা যে প্রতিকূলতা ও শারীরিকভাবে কষ্টকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন তা সহজ ও সহনীয় করে তোলার জন্য।
৩০ বছর আগে এমনকি ১০ বছর আগেও যারা হজে এসিছিলেন বর্তমান মিনা শহর তারা চিনে উঠতে পারবেন না।
১৯৮০ সালে মিনা দেখতে কেমন ছিল হজে আসা সুদানী হাজী আহমদ মুহাম্মদের কাছে তার বিশদ বর্ণনা শুনতে পাওয়া যায়। হাজী আহমদ মুহাম্মদ বলেন, তখনকার দিনে শহরের প্রধান স্থাপনাটি ছিল মসজিদ আল-কায়েফ। মিনার কেন্দ্রস্থলে ছিল মসজিদটি। হাজীরা মক্কা থেকে সরাসরি চলে আসতেন এই মসজিদে।
এই শহরেই দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের বহু লোকের সঙ্গে হাজী সাহেবের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বন্ধুদলে যুক্ত হন পাকিস্তানী, ইন্ডিয়ান, মালয়েশিয়ান ও আমেরিকান। তাঁবু তখনও ছিল এবং ছিল বিপুল সংখ্যায়, কিন্তু আজকের মতো সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে বিন্যস্ত সেগুলো ছিল না। প্রচুর খালি জায়গা পড়ে ছিল।
শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মারার যে প্রতীকি ক্রিয়ানুষ্ঠান হাজীরা পালন করে থাকেন যে জামারাত ব্রিজে, সে ব্রিজটি তখন ছিল হেঁটে পারাপারের পথচারীদের ব্রিজের মতো। দোতলা ছিল ব্রিজটি এবং ছিল খুব ছোট। কিন্তু তখনকার দিনে আসা স্বল্পসংখ্যক হজযাত্রীদের প্রয়োজনীয়তা তাতেই মিটে যেত। আলহাজ্জ আহমদ বলেন, পরবর্তী বছরগুলোয় হজ্জযাত্রীর সংখ্যা বেড়ে কয়েক লাখে পৌঁছালে ব্রিজটি পরিণত হয় মৃত্যুফাঁদে। প্রায় ১৭ বছর কেটে যাবার পর ভারত থেকে আবার হজ্জে এসেছেন মাওলানা মকবুল রহমানি। ১৯৯৭ সালে তিনি হজ্জ করতে এসেছিলেন। তাঁবুর শহরটিতে প্রচ- অগ্নিকা-ে সে বছর প্রায় সাড়ে তিনশ’ হজ্জ যাত্রীর মুত্যুর ঘটনা স্মরণ করে জনাব রহমানি বছরটিকে স্মরণ করেন অগ্নিকা-ের বছর হিসেবে। সৌদি কর্তৃপক্ষের প্রশংসায় পঞ্চমুখ রহমানি। তিনি উল্লেখ করেন, ঐ অগ্নিকা-ের পরের বছরই শহরজুড়ে অত্যাধুনিক অগ্নি প্রতিরোধক তাঁবু স্থাপনে নামে সৌদি সরকার। ফাইবার গ্লাসের তৈরি প্রতিটি তাঁবু ট্যাফøনের আবরণে আবৃত করা হয় এবং পানি ছিটানোর যন্ত্র জুড়ে দিয়ে প্রতিটি তাঁবুকে তাপ-সহনীয় করে তোলা হয়। তাঁবুতে আরো জুড়ে দেয়া হয় এলার্ম সিস্টেম ও বৈদ্যুতিক আলো। মিনার চেহারা বদলে যায়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তাঁবু খাটানোয়। অগ্নিকা-ের পরবর্তী কঠিন চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে ছিল শয়তানকে পাথর ছোঁড়ার ক্রিয়ানুষ্ঠানে শৃঙ্খলা নিয়ে আসা।
জেদ্দাভিত্তিক হজ্জ সঞ্চালক আবরার সিদ্দিকী বলেন, জামারাত ব্রিজে ঘটা দুর্ঘটনা প্রথায় পরিণত হয়ে যাওয়ায় এর মোকাবিলায় কাজটি একটি দুঃসহ বিভীষিকা হয়ে দেখা দেয় সরকারের সামনে। কিন্তু সরকার দমে থাকেনি। পানি ছিটানোর ব্যবস্থা ও এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা জুড়ে দিয়ে এবং বহু নির্গমন পথসহ বহুতল স্থাপনা সরকার বহু বিলিয়ন খরচে গড়ে তোলে পরবর্তীতে পুরাতন কাঠামো ভেঙে দিয়ে। সিদ্দিকী বলেন, আজকাল ক্রিয়ানুষ্ঠান উদযাপন একেবারেই সহজ।
মক্কা থেকে মিনা এবং মিনা থেকে আরাফাত হয়ে আবার মুজদালিফায় ও মিনায় পৌঁছাতে প্রচ- ভিড় ও অচলাবস্থারÑহজ্জযাত্রীদের আগের দিনে সম্মুখীন হতে হতোÑ বলেন টিভি জার্নালিস্ট ইয়াসির আল কাহ্তানি। মাত্র ৫ কি: মি: পথ আরাফাত থেকে মুজদালিফা ও মিনায় পৌঁছাতে বাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হজ্জযাত্রীদের বসে থাকতে হতো। ডজন ডজন রাস্তা সরকার তৈরি করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হজ্জের পবিত্র দিনটিতে দেখা দিতো ভয়াবহ ট্র্যাফিক জ্যাম।
আল কাহ্তানি বলেন, এরপরই সরকার হজ্জ ট্রেন চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। মিনা থেকে আরাফাত এবং আরাফাত থেকে আবার মিনায় ফেরার জন্য হাজার হাজার তীর্থযাত্রী আজকাল হজ্জ-মেট্রো ব্যবহার করেন। দীর্ঘদিনের জেদ্দা অভিবাসী রিফাত আঞ্জুম বলেন, ২০০০ সালে তিনি হজ্জ পালন করেন। তিনি বলেন, সে দিনগুলোয় আমরা তাঁবুতে থাকিনি। থাকতাম জামারাত ব্রিজের কাছাকাছি একটি ইমারতে। জামারাত দিবসে জানালা দিয়ে আমরা তাকিয়ে দেখতাম ভিড়ের চাপ খুব বেশি কিনা।
তিনি বলেন, ঐ বিল্ডিংগুলো আজ আর নেই। পুরনো শহর বদলে গেছে নতুন একটি শহরে ও আধুনিক চেহারায়। স্বাস্থ্য সুবিধার আধুনিক জবেহ-গাহ, ওভারব্রিজ, পথচারীদের জন্য সড়ক এবং এলিভেটেক ট্রেন স্টেশন- সবমিলিয়ে মিনা একটি সর্বাধুনিক শহর আজ।