লন্ডনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত মুক্তিযোদ্ধা মান্না হক
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লন্ডনে সমাহিত করা হয়েছে সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠশিল্পী মান্না হককে। গ্রেটার লন্ডনের এসেক্সের মুসলিম কবরস্থান গার্ডেন অব পিসে বুধবার স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে তিনটায় যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়।
শেষ শয্যার আগে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় মোড়ানো প্রয়াত এ মুক্তিযোদ্ধার মরদেহকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন লন্ডনে বসবাসরত তারই মুক্তিযোদ্ধকালীন পাঁচ সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলার খলিল কাজি, সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান, মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেইন, মুক্তিযোদ্ধা শাহ এনাম ও প্রয়াত মান্না হকের বড় ভাই, বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের প্রেস সেক্রেটারি সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল হক বাদশাহ।
এ সময় ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মিজারুল কায়েস, প্রেস মিনিস্টার রাশেদ চৌধুরী, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি লিডার রাজন উদ্দিন জালাল ও সাবেক কাউন্সিলার শাহাবুদ্দিন বেলালসহ কমিউনিটির বিপুল সংখ্যক মানুষ নীরবে দাঁড়িয়ে প্রয়াত এ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
হাইকমিশনারের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে মান্না হককে সমাহিত করা হয় গার্ডেন অব পিসে। এরপর উপস্থিত বিপুল সংখ্যক মানুষ মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করেন। প্রয়াত এ মুক্তিযোদ্ধায় শেষ যাত্রায় তার ছেলেসহ আত্মীয় স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।
মান্না হকের দাফন শেষে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে হাইকমিশনার মিজারুল কায়েস বলেন, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম একে একে চলে যাচ্ছেন আমাদের মাঝ থেকে। পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে নিজেদের প্রাণবাজি যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি আমাদের উপহার দিয়েছিলেন তারা। বিনিময়ে আমরা তাদের কি দিতে পেরেছি এটি নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে প্রয়াত মান্না হকের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে হাইকমিশনার বলেন, আমি আজ নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি এই ভেবে যে, মান্না হকের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার শেষ যাত্রায় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমি প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের বিনিময়মূল্য অবশ্যই কিছু হতে পারে না, এরপরও তাদের শেষ যাত্রায় রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের রীতি চালু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতি হিসেবে আমাদের মানসিক স্বস্থি খোঁজার একটি পথ বাতলে দিয়েছেন। মান্না হকের শেষ যাত্রায় শরিক হয়ে সেই স্বস্থিই খুঁজছি আমি। তিনি প্রয়াত এই মুক্তিযোদ্ধার আত্মার শান্তি কামনা করেন।
উল্লেখ্য, গত ৯ অক্টোবর (বুধবার) লন্ডন সময় সন্ধ্যা ৬টায় পূর্ব লন্ডনের আইল অব ডগের নিজ বাসভবনে বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী, মুক্তিযোদ্ধা মান্না হক শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। কুষ্টিয়ার লালন ফকিরের পরিবারের সন্তান মান্না হক মরহুম খ্যাতিমান অভিনেতা রাজু আহমেদ ও বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের প্রেস সেক্রেটারি সাংবাদিক আমিনুল হক বাদশার ছোট ভাই। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে ও বড়ভাই আমিনুল হক বাদশাহসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী ও আত্মীয় স্বজন রেখে গেছেন।
১৯৮০ সালে মান্না হক প্রথম ব্রিটেনে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস এবং বাঙালি কমিউনিটির ছেলে-মেয়েদের ব্যক্তিগত ভাবে সঙ্গীত শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে তার এ শিক্ষাদান গ্রুপ এবং সর্বশেষ স্কুল ভিত্তিতে পরিণত হয়। ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে একজন জনপ্রিয় ও সফল সংগীত শিল্পী হিসেবে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।
একজন দেশপ্রেমিক শিল্পী হিসেবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধে প্রয়াত মান্না হক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন। ওই সময় তার গাওয়া গান রনাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করতো। ৮০ সালে ব্রিটেনে আসার পর লন্ডনের বাংলাদেশ সেন্টার, কবি নজরুল সেন্টার, ফেডারেশন অব বাংলাদেশি ইয়ুথ অর্গানাইজেশন ইউকে, বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগ, খেলাঘর ও জয় বাংলা ব্যান্ডসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি।
ওই সব সংগঠনের মাধ্যমে কমিউনিটিতে মান্না হক ব্যাপকভাবে বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটান। শহীদ জননী জাহানার ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নির্মূল কমিটির সঙ্গেও তিনি সম্পৃক্ত হন লন্ডনে।
এদিকে, মান্না হকের মৃত্যুতে কমিউনিটি নেতাদের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পাঠানো শোকবার্তায় একাত্তরের মহান মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত এ সংগীত যোদ্ধার অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তার আত্মার শান্তি কামনা করা হয় ও শোক সন্তপ্ত পরিবার পরিজনদের প্রতি গভীর সমেবেদনা প্রকাশ করা হয়।
যারা শোক বার্তা পাটিয়েছেন তাদের উল্লেখ যোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন, বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে তার ঘনিষ্ট সহকর্মী সাবেক কাউন্সিলার রাজন উদ্দিন জালাল, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক মেয়র আকিকুর রহমান, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা আনসার আহমেদ উল্লা, থিও ফরিদ উদ্দিন, একেএম নেসাওয়ার, সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী, সাবেক কাউন্সিলার সোনাহর আলী, সাবেক কাউন্সিলার নুর উদ্দিন আহমেদ, ফানু মিয়া, প্রয়াতের বাল্যবন্ধু এ রফিক ও জামাল হাসান প্রমুখ।