প্রকৃতি লোভ ছড়ায় ‘লোভাছড়া’য়

Binoশুয়াইব হাসান : সীমান্তের বড় বড় পাহাড় ছুঁয়ে নেমেছে ঝর্ণা। চারদিকে সবুজ বেষ্টিত চা বাগান, সারি সারি গাছ, পাহাড় আর বালু সমৃদ্ধ স্বচ্ছ পানির বহমান নদী। অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে প্রাকৃতিক নৈসর্গের আরেক রূপ। নাম ‘লোভাছড়া’। সিলেটের সীমান্তবর্তী কানাইঘাট উপজেলায় অবস্থিত মনোমুগ্ধকর অপূর্ব এই সৃষ্টি। প্রকৃতি যেখানে তারে সৌন্দর্যের লোভ ছড়ায়!
লোভাছড়া থেকে ভারতের পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয় খুব বেশী দূরে নয়। এখাকার যে কোন উঁচু পাহাড়ে উঠলে মেঘালয়ের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় খুব কাছে থেকে দেখা যায়। লোভাছড়ায় আছে একটি চা বাগান, নাম লোভাছড়া টি এষ্টেট। এর মালিক ছিলেন একজন ইংরেজ।
সিলেট শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে কানাইঘাট উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত লোভাছড়া নদীর পাশেই ব্রিটিশ আমলে প্রায় ১৮৩৯ একর জমির উপর গড়ে ওঠে লোভাছড়া চা-বাগান। বাগানের উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য এবং পশ্চিমে বাংলাদেশের একটি পিকনিক স্পট ও লালাখাল চা-বাগান অবস্থিত।
বাড়তি আকর্ষণ ‘খাসিয়া পুঞ্জি’। এখানকার খাসিয়াদেরও আদি নিবাস ছিল খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়। বহু বছর পুর্ব থেকে এদের লোভাছড়ায় বসবাস। লোভাছড়া থেকে ৫ কি. মি উত্তরে গভীর জঙ্গলের ভিতরে কয়েকটি বিশাল আকৃতি পাথর রয়েছে। এক একটি পাথরের উচ্চতা হবে প্রায় ৩০ ফুট। প্রতিটি পাথর গোলাকার। চওড়া হবে প্রায় ৫০ ফুট। এই পাথরগুলোর অবস্থান পাহাড়ের নিচে।
পাহাড়ের কোল জুড়ে গাছপালার সবুজ বর্ণিল রংয়ে আচ্ছাদিত হয়ে আছে লোভাছড়া চা-বাগান। মাটির রাস্তা ধরে যতদূর এগুনো যায় চোখে পড়ে ছোট-বড় নানা ধরনের গাছপালা। চা-বাগানের মাঝে গাছগুলো সারি-সারিভাবে সাজানো। এর সৌন্দর্য্য যে কাউকে মুগ্ধ করে।
লোভাছড়ার পাশ দিয়ে ভারত সীমান্তে হারিয়ে গেছে ‘নুনগাঙ’। ‘নুনগাঙ’ প্রায় নদীর মত হলেও এটি আসলে ঘোলা পানির একটি খাল যা লোভাছড়া নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে। খালের উপর বেশ পুরনো তবে এখনো মজবুত স্টীলের তৈরী একটি ব্রীজ রয়েছে, যার উপরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ-ভারত উভয় সীমান্তের পাহাড়ঘেরা আবছা ছবি চমৎকারভাবে ভেসে ওঠে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভোর সকালে লোভাছড়া বাগানে হরিণ, খরগোশ, আর বন মোরগ চোখে পড়ে। রাতের আঁধারে শোনা যায় বাঘের গর্জন। একথায় লোভাছড়া চা-বাগান বন্যপ্রাণীরও অভয়াশ্রম। বাগান কর্তৃপক্ষের একটি বিশাল আকৃতির পোষা হাতি রয়েছে, যেটি সবসময় বাগানে অবাধ চলাফেরা করে।
লোভাছড়ায় পর্যটকের জন্য থাকার কোন সু-ব্যবস্থা না থাকলেও বাগান মালিক কর্তৃপক্ষের জন্য রয়েছে ৪টি বাংলো। বাংলোগুলোর বাহ্যিক দৃশ্যগুলোও বেশ নান্দনিক। বাংলোর কাছাকাছি জায়গায় রয়েছে কয়েকটি কফি গাছ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব এই রূপ ‘লোভাছড়া’ কেবল পর্যটক আকর্ষণ নয়, দেশের অর্থনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। লোভাছড়া বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা লোভা নদী থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক পাথর উত্তোলন করেন। এই নদীর পাথর ও বালু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যায়।
লোভাছড়া এলাকার জনসাধারন চাষাবাদ এবং পাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এলাকার মানুষগুলো খুবই সহজ সরল। লোভাছড়ায় টিলার উপর একটি প্রাচীন জমিদার বাড়ী রয়েছে। ১৯০৯ সালে একজন সমাজ সেবক ইংরেজ মেজর লোভা ছড়ায় এসে জমিদারীর গোড়া পত্তন করেন।
যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব এই সম্ভাবনাময় স্থানটি। যা পর্যটন সমৃদ্ধ সিলেট এবং গোটা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
লোভাছড়া চা বাগানের ম্যানেজার জহুরুল হক জানান, প্রতিবছর শীত মৌসুমে কিছু পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি তাদের জন্য সহযোগিতা করতে।
কানাইঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম সোহরাব হোসেন বলেন, লোভাছড়ায় যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌকা। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটক আকর্ষণ এখনও বাড়েনি।
এটি একটি আধুনিক পর্যটন এলাকা হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রচারণা এখনও তেমন হয়নি। প্রচার-প্রচারণা বাড়লে এর আকর্ষণও বাড়বে। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ঘুরতে আসবেন। আনন্দ পাবেন। পর্যটন থেকে দেশও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
যেভাবে যাওয়া যাবে লোভাছড়ায়: সিলেট শহর থেকে তিনটি সড়কে কানাইঘাট সদরে পৌঁছার সুযোগ আছে। বাস অথবা সিএনজি-অটোরিঙাযোগে সরাসরি দরবস্ত-চতুল হয়ে কানাইঘাট সদরে যাওয়া যায়। অন্যদিকে, গোলাপগঞ্জ-চারখাই-শাহবাগ হয়ে জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে কানাইঘাট পৌঁছা যাবে। এছাড়া গাজী বুরহান উদ্দিন সড়ক দিয়ে সিলেট-গাছবাড়ী সড়ক দিয়ে কানাইঘাট সদরে পৌছার সুযোগ রয়েছে।
সিলেট শহর থেকে কানাইঘাট সদরে বাসভাড়া সর্বোচ্চ ৬০টাকা এবং সিএনজি-অটোরিঙা ভাড়া সর্বোচ্চ ১শ’ টাকা। রিজার্ভ সিএনজি ৫শ’ ৭শ’ টাকা হবে। তিন পথেই সিএনজিযোগে যাওয়া যাবে কানাইঘাটে। চলতি বছর কানাইঘাটে সুরমা নদীর উপর ব্রীজ চালু হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো সহজ হয়েছে।
কানাইঘাটে পৌছার পর বাজার হতে নৌকাযোগে যেতে হবে লোভাছড়ায়। জনপ্রতি ৩০ থেকে ৪০টাকা নৌকা ভাড়া লাগবে। এছাড়া রিজার্ভ নৌকা নিলে ৩শ’ টাকার বেশি হবে না। আর লোভাছড়া ঘুরতে সময় লাগবে প্রায় ৩ থেকে ৪ঘন্টা। সবুজে আচ্ছাদিত, অপরূপ বন, স্বচ্ছ পানির ঝর্ণা আর নদী, পাথর সমৃদ্ধ লোভাছড়া; যা আপনাকে বিমোহিত করবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button