বিশ্বকাপকে ঘিরে প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন বিপন্ন
প্রতি বছর দক্ষিণ এশিয়ার হাজারো মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে যান উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের কারণে বহু প্রবাসী শ্রমিক অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন। তাই সমালোচনার মুখে পড়েছে কাতার। নেপালের অভিবাসী শ্রমিক বিদে মাজাকোটি উঁচু সুদে ঋণ নিয়ে কাতারে কাজ করতে গিয়েছিলেন। তাকে গ্যারেজে কাজ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০ ফিট উঁচু একটি ভবনের কাজে লাগানো হয়েছিল। সেখানে কাজ করা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং সে সময় ব্যবস্থাপক বলেছিলেন, সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের নয়। কোনো সময় পারিশ্রমিক পেতেন, কোনো সময় তাও দেয়া হতো না। ফলে ঋণ শোধ তো দূরের কথা, খাওয়া-পড়ার খরচও জুটত না তার। নেপালে ফিরে মেয়ের অস্ত্রোপচারের জন্য ভিটেবাড়ি ও জমি বিক্রি করতে হয়েছে মাজাকোটিকে। এখন তিনি নিঃস্ব। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন বা আইটিইউসি’র সমর্থিত ইকুয়াল টাইমসকে এসব কথা জানিয়েছেন কাতার ফেরত নেপালি শ্রমিক মাজাকোটি। মাজাকোটি একা নন, দক্ষিণ এশিয়ার এমন হাজারও শ্রমিকের সঙ্গে একই ঘটনা ঘটেছে। যারা প্রতি বছর উন্নত জীবনের আশায় মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান। কিন্তু সেখানে গিয়ে খারাপ আবাসন সমস্যা, চিকিত্সার অভাব, আইনগত সুবিধা এবং অর্থের অভাবের মুখোমুখি হতে হয় তাদের।
একবিংশ শতাব্দীতে দাসত্ব
আইটিইউসি’র মতে, ১২ লাখ অভিবাসী শ্রমিক কাতারে নির্যাতন ও শোষণের শিকার হচ্ছেন, যাকে তারা একবিংশ শতাব্দীর দাসপ্রথা হিসেবে উল্লেখ করেছে। নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ থেকে আসা এসব শ্রমিক গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতেও ভয় পান, পাছে তাদের দেশে ফিরিয়ে দেয়া হয়, কিংবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। বেশিরভাগ শ্রমিক দরিদ্রতা, কর্মসংস্থানের অভাবের জন্য নিজের সম্পদ বিক্রি করে বেশি অর্থ উপার্জনের আশায় মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেন।
বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, সেগুলো তারা পালন করে না। এমনকি বেশিরভাগ সময় এসব সংস্থা অবৈধ কাগজপত্র তৈরি করে এদের অবৈধভাবে বিদেশে পাঠায়। এশিয়া ফাউন্ডেশনের নন্দিতা বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ঋণের চাপ এবং অবৈধ প্রবেশের কারণে বেশিরভাগ সময় অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য হন এসব শ্রমিক। আইটিইউসি’র মহাসচিব শারান বুরো বলেছেন, বেশিরভাগ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এসব শ্রমিক একই জায়গায় গাদাগাদি করে থাকেন, যেখানে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই।
কাফেলা ব্যবস্থা
রাষ্ট্র পরিচালিত কাফেলা বা স্পন্সর ব্যবস্থায় এই শোষণের মাত্রা আরও প্রতিফলিত হয়। এর মাধ্যমে শ্রমিকদের তাঁদের কাজ পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়, এমনকি ‘ওয়ার্ক পারমিট’ ছাড়াই কাজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাতারের শ্রম আইন মেনে কর্তৃপক্ষ কোনো কাজই করে না। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাতারে শ্রম পরিদর্শক রয়েছেন মাত্র ১৫০ জন এবং তাদের পরিদর্শনে শ্রমিকদের সাক্ষাত্কার অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব অভিযোগের ব্যাপারে ডয়চে ভেলে কাতারের শ্রমমন্ত্রীর কাছে কিছু প্রশ্ন করলে তিনি কোনো উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান।
ফিফা এ বিষয়ে সতর্ক
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, কাতারে গ্রীষ্মে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে ৪৪ জন নেপালি শ্রমিক নিহত হয়েছেন। নেপাল দূতাবাস জানিয়েছে, গত বছর আরব আমিরাতে ১৫১ জন নেপালি শ্রমিক নিহত হন। যাদের মধ্যে ৮৫ জন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে মারা যান।
এ রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় কাতার কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, যেসব অভিযোগ উঠেছে তা তদন্ত করতে কমিশন গঠন করা হবে এবং তারা শ্রম পরিদর্শকের সংখ্যা দ্বিগুণ করবে। তবে নেপালি শ্রমিকদের সঙ্গে দাসদের মতো আচরণ করা হতো এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তারা। এদিকে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে যে, গণমাধ্যমের এসব প্রতিবেদনের দিকে লক্ষ্য রাখছেন তারা। বিশ্বকাপ নির্মাণ কাজ প্রকল্পে খারাপ কর্ম পরিবেশ এবং শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে তারা কাতার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবে।
শ্রম ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন
যদিও গণমাধ্যমের এসব প্রতিবেদনের কারণে দোহা চাপের মুখে রয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রতিবেদন কাতার কর্তৃপক্ষের আচরণে কোনো পরিবর্তন আনবে না। কেননা একই চিত্র সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত আর কুয়েতেও বর্তমান। বিশ্লেষকরা বলছেন, কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনের মনোন্নয়নের জন্য শ্রম ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। বিশেষ করে, বিশ্বকাপকে সামনে রেখে নির্মাণ কাজের জন্য যেখানে আগামী বছরগুলোতে কয়েক লাখ শ্রমিক আনার পরিকল্পনা করছে কাতার, সেখানে এ অবস্থান উন্নতি প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। নন্দিতা বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে জানান, যেসব দেশ বিশ্বকাপে অংশ নেবে সেসব দেশ যদি কাতার কর্তৃপক্ষকে চাপ প্রয়োগ করে, একমাত্র তবেই এ অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।