আওয়ামীলীগ আত্মস্বীকৃত ফ্যাসিস্ট, এটা প্রতিষ্টিত সত্য: লন্ডনে নাগরিক সংবর্ধনায় ডাঃ শফিক

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, সত্য একবার বললেই প্রতিষ্ঠিত হয় কারণ সেটা সত্য। আর মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত করতে বারবার বলতে হয়। আওয়ামীলীগ আত্মস্বীকৃত ফ্যাসিস্ট। এটা প্রতিষ্টিত সত্য। তিনি ১৭ নভেম্বর রোববার লন্ডনের তাঁর সম্মানে আয়োজিত এক ‘সিভিক রিসিপশন’ অনুষ্ঠানে প্রধান অথিতির বক্তব্য রাখছিলেন।
তিনি বলেন, ১৬ বছর দেশের মানুষের সাথে আওয়ামীলীগ যে আচরণ করেছে তার জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে। তারা মানুষের অধিকারই শুধু হরণ করেনি, তারা দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরী করে রেখেছিলো। তারা চোখের সামনে মানুষকে হত্যা করেছে। আমরা চাই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের বিচার হোক।
ডাঃ শফিক বলেন, অন্যায় বিচার কি সেটার আমি নিজেও একজন ভিকটিম। আমাকে গ্রেফতার করে বলা হয়েছে, আমি নাকি বিছানার নিচে ককটেল নিয়ে ঘুমিয়েছি!
তিনি বলেন ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি মাসে পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ৫৭জন কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ তাদের খুনের রাজনীতি শুরু করেছিল। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়ার হীন প্রচেষ্টা চালায় এবং একই সাথে বিডিআর বাহিনীকেও শেষ করে। এই দুই খুনের মিশনের পর তারা আঘাত করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উপর। আমাদের উপর যখন আঘাত আসে, তখন আমাদের জাতির বিবেকবান নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করতে পারেননি যে এই আঘাত শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে? ডাঃ শফিক ভারাক্ষান্ত মনে সে পরিস্থিতির বর্ণনা করে বলেন, আমরা যখন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি তখন আমাদের অনেক বন্ধুকে বলেছিলাম, আসুন একসাথে লড়াই করি। তা না হলে ফ্যাসিবাদের কবলে সবাইকে পড়তে হবে। কিন্তু অনেকেই ভেবেছিলেন, এ রকম পরিস্থিতি যদি জামায়াতের উপর দিয়ে যায় তবে দেশ বুঝি শান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু না, সেটার পরিণতি আজ দেশবাসীর কাছে একটি জ্বলন্ত ইতিহাস। আমরা হয়ত সেদিন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলাম।
পূর্ব লন্ডনের দ্যা রয়েল রিজেন্সি হলে “কোয়ালিশন ফর পিস এন্ড জাস্টিস ইন বাংলাদেশ”-এর আয়োজনে কয়েক সহস্রাধিক জনতার বিশাল সংবর্ধনায় ডাঃ শফিক যুক্তরাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের নির্যাতনের কারণে যারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল, যুক্তরাজ্য সরকার তাদের আশ্রয় দিয়েছে এমনকি নাগরিকত্বও দিয়েছে। আমরা এ জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা আপনাদের কাছে অনুরোধ করবো নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে আপনারা বাংলাদেশে আইনের শাসন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুন। আপনারা কোন দুস্কৃতকারীকে এখানে প্রশ্রয় দেবেন না। যারা দেশের টাকা পাচার করেছে, লুন্ঠন করে এখানে পালিয়ে এসেছে, আপনারা তাদের পাকড়াও করে ঐ টাকাগুলো আমাদের ফেরত দিয়ে সাহায্য করুন। দেশের মানুষ শ্রদ্ধাভরে সারাজীবন আপনাদের এই অবদান স্মরণ করবে।
তিনি প্রবাসীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আপনারা আমাকে সংবর্ধনা নিয়ে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে সম্মানিত করেছেন। আমরা আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।আমরা যখন আওয়ামীলীগের অনেক অপরাধ-অপকর্মের প্রতিবাদ করতে পারিনি, তখন আপনারা তাদের প্রত্যেকটি অপকর্মের সর্বোচ্চ প্রতিবাদ করেছেন। আপনাদের প্রতিদান দেয়ার সামর্থ আমাদের নেই। তবে আমি ও আমার দল আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনারা দেশ ও জাতির পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আপনাদের দেশপ্রেম ও দেশের মানুষে ভালোবাসার সর্বোচ্চটুকু ঢেলে দিয়েছেন। আপনার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছেন, এখন মেধার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশ পুনর্গঠনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।
জামায়াতের আমীর ডাক্তার শফিকুর রহমান বলেন, আমরা একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে দেশের প্রত্যেক নাগরিক স্বীয় মর্যাদার সাথে বসবাস করবে। আমরা এমন সমাজ চাই যেখানে মসজিদ পাহারার প্রয়োজন না হলে মন্দির পাহারারও প্রয়োজন হবে না। যেখানে আমাদের নারীরা মর্যাদা ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করবে। রাসূল (স.) এর সময় নারীরা যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিল। তিনি আরও বলেন, আমাদের বিশাল ম্যানপাওয়ারকে আমাদের জন্য আশির্বাদ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। যারা প্রবাসে নাগরিকত্ব পান না এবং ইন্তেকালের পর যাদের আত্নীয়রা তাদের লাশ দেশে নিতে চান, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তারা যেন তা করতে পারেন তার জন্য আমরা তাদের সহযোগিতা করব।
জামায়াতের নেতৃবৃন্দকে জুডিশিয়াল কিলিং এর মাধ্যমে শহীদ করা হয়েছে উল্লেখ করে ডা. শফিক বলেন, বেগ্ম খালেদা জিয়া, সাবেক আমীরে জামায়াত প্রফেসর গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামীসহ জামায়াতের সকল নেতাদের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ ছিল মিথ্যা ও বানোয়াট। এটা প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি ২০২৪ এর জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থানের ভয়াবহ স্মৃতি উল্লেখ করে বলেন, ছাত্ররা তাদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল, পরে জনতা তাদের সাথে রাস্তায় নেমে আসে। শহীদ আবু সাঈদ দু হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দিয়ে বলেছিল, হয় অধিকার দাও, না হয় গুলি কর। তারা অধিকার না দিয়ে গুলি করে অসম্ভব মেধাবী এই ছেলেকে হত্যা করে তার পরিবারের আশার আলো নিভিয়ে দিল। সে একা নয়, দেড় বছরের কুলের শিশুসহ, আমাদের ধারণা মতে ১৬০০/১৬৫০ জনকে হত্যা করা হলো। যারা আহত ও পঙ্গু হয়েছে, হাসপাতালে আছে আমরা একটা দল হিসেবে আমাদের সাধ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাড়িয়েছি এবং আরও দাড়াব। কিন্তু প্রয়োজন এত বেশী যে তা কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে এমনকি রাষ্ট্রের পক্ষেও একা সম্ভব নয়। আমাদের অনুরোধে ২/৩ টি বন্ধু দেশ এগিয়ে এসেছে। আশা করি আহতদের সহায়তায় আরও কিছু দেশ এগিয়ে আসবে।
ডাঃ শফিক বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর আমরা রাজনৈতিক দলগুলো যুলুম-নির্যাতন ও জাতির উপর নিষ্পেষণের প্রতিবাদ করেছি কিন্তু আন্দোলের সমাপ্তি টানতে পারিনি। তিনি বলেন আমাদের হয়তো অনেক ত্যাগস্বীকার করতে হয়েছে , অনেক জীবন দিতে হয়েছে, অনেকে পংগুত্ব বরণ করতে হয়েছে , দফায় দফায় জেলে গিয়েছেন, চাকুরীহারা হয়েছেন এমনকি কারো কারো বুলডোজার দিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়া হয়েছে। এই সব গুলোই ছিল বাস্তবতা। কিন্তু আমরা সে আন্দোলনের সরাসরি ফসল ঘরে তুলে আন্তে পারিনি। আমাদের সন্তানের, আমাদের ছেলে-মেয়েরা এই বছরের পহেলা জুলাই থেকে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল এবং তাদের ডাকে সাধারণ মানুষ সাড়া প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসে দুঃশাসনের চূড়ান্ত বিদায় জানিয়েছে।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ও কমিউনিটির ব্যক্তিত্ব মুফতি শাহ সদরুদ্দিন, বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ও উলামা মাশায়েখ ইউকে’র সভাপতি শায়খ মওদুদ হাসান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ইউরোপের মুখপাত্র ব্যরিস্টার আবু বকর মোল্লা, শিক্ষাবিদ প্রফেসর ডক্টর হাসনাত হোসাইন এমবিই, গ্রেটার সিলেট ডেভলাপমেন্ট এন্ড ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার আতাউর রহমান, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও চ্যানেল এস এর ফাউন্ডার মাহি ফেরদৌস জলিল, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও চ্যানেল আই ইউরোপের সাবেক এমডি রেজা আহমেদ ফয়সল চৌধুরী শুয়েব, বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ, মানবাধিকার সংগঠন মুসলিম ভয়েস এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মাহফুজ নাহিদ, কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব মির্জা আসহাব বেগ, টাওয়ার হেমলেটস কাউন্সিলের স্পিকার ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন খালেদ, দৈনিক আমার দেশের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট অলিউল্লাহ নোমান, বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব মাওলানা সাদেকুর রহমান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী পুত্র ব্যারিস্টার নাজিব মোমিন, কাউন্সিলর গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী ও দা সানরাইজ টুডে’র সম্পাদক সাংবাদিক এনাম চৌধুরী প্রমুখ।
সাবেক ছাত্র নেতা আবু সালেহ ইয়াহইয়া ও শামসুল আলম গোলাপ এর পরিচালনায় পূর্বলন্ডনের দ্যা রয়েল রিজেন্সি হলে অনুষ্ঠিত নাগরিক সংবর্ধনা’য় উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন সিলেট মহানগর জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারী সিরাজুল ইসলাম শাহীন।
উপস্থিত ছিলেন, টাওয়ার হেমলেটস কাউন্সিলের সাবেক স্পিকার কাউন্সিলর জাহেদ চৌধুরী, কাউন্সিলর কবির হোসাইন, কাউন্সিলর ফারুক খান এবং কাউন্সিলর আহমদ আল কবির প্রমুখ।
মাওলানা হাফিজ কাজি হামিদুল হক এর তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে শিল্পী নওশাদ মাহফুজ ও কামাল হোসাইনের নেতৃত্বে শিল্পীদের দুটি পৃথক দল ইসলামিক নাশিদ পরিবেশন করেন।
লন্ডনের বাংলাদেশী কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বিপুল সংখ্যক সাধারণ জনতা, নেতাকর্মী ও সুধী-শুভানুধ্যায়ীদের উপস্থিতিতে নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি এক বিশাল গণজমায়েতে রূপলাভ করে। এ সময় অনুষ্ঠানের আয়োজক কোয়ালিশন ফর পিস এন্ড জাস্টিস ইন বাংলাদেশ এর পক্ষ থেকে মাহফুজ নাহিদের নেতৃত্বে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button