মুসলমান নির্মূলে নীলনকশার বাস্তবায়ন হচ্ছে মিয়ানমারে
অক্টোবরের প্রথম দিকে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সফরকালে শত শত বৌদ্ধ ধর্মীয় উগ্রপন্থী সমুদ্র তীরের বিনোদন শহর থানডয়ের কাছে মুসলমানদের এক গ্রামে চড়াও হয়। তারা গ্রামের ৭০টিরও বেশি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় ও ৯৪ বছরের এক বৃদ্ধাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এ হামলা ছিল মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ধর্মীয় দাঙ্গার সর্বশেষ ঘটনা। সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের হামলা প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। গত এক বছরে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সত্ত্বেও এবং একনায়কতান্ত্রিক শাসনের কারণে পাশ্চাত্যের সাথে বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটলেও সেখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার ট্র্যাজিক ঘটনা এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, দেশটি এখনো দশকের পর দশক ধরে সামরিক শাসনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সাম্প্রতিক কালে সেখানে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় সহিংসতার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে- সেখানে ২০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান তাদের আত্মপরিচয় ও অস্তিত্ব সঙ্কটের সম্মুখীন। বিবিসি রোহিঙ্গাদের বিশ্বের সর্বাপেক্ষা নির্যাতিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর একটি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
রোহিঙ্গারা ছিল ঐতিহাসিক আরাকান রাজ্যের অধিবাসী। ১৯৪৮ সালে বার্মা ইংরেজ শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এ সময় সীমান্তবর্তী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে আরাকান রাজ্যের যোগদানের আলোচনা সত্ত্বেও তা বার্মার অংশ হিসেবেই থেকে যায়। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে সামরিক জান্তা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বর্মী ও বৌদ্ধ হিসেবে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে। এটা ছিল মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতা অং সান-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পৃথক। অং সান ১৯৪৭ সালে ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার আগে তার স্বল্পমেয়াদি অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী কমিটিতে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে আরাকান রাজ্যের নাম পাল্টে রাখাইন প্রদেশ করা হয়। একই সময়ে বার্মার নামকরণ করা হয় মিয়ানমার।
মুসলিম রোহিঙ্গারা অবর্মি ও অবৌদ্ধ। তাদের বিদেশী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শুধু তাই নয়, তাদের ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মায় এসে বসতি স্থাপনকারী ‘অবৈধ বাঙালি অভিবাসী’ বলা হয় যা সঠিক নয়। সত্তর দশকের শুরুর দিকে বর্মী সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জাতিকে জাতিগোষ্ঠীগতভাবে নির্মূলের অভিযান শুরু করে। প্রথম দিকের এ ধরনের একটি অপারেশনের নাম ছিল নাগা মিন বা কিং ড্রাগন। বার্মায় কথিত ‘অবৈধ অভিবাসী’ চিহ্নিত ও তাদের বহিষ্কার করার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে এ অপারেশন পরিচালনা করা হয়। কিং ড্রাগনের প্রতীক বৌদ্ধ পুরাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘বিদেশী’দের কথিত ‘হুমকি’ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্রতা রক্ষায় সামরিক বাহিনীর ব্যাপকভিত্তিক জাতিগোষ্ঠীগত নির্মূল অভিযানের প্রথম পদক্ষেপ ছিল পরিচয় যাচাই। এ অভিযান চলাকালে রোহিঙ্গারা ব্যাপকভিত্তিক ধর্ষণ, নির্বিচার গ্রেফতারের শিকার হয়। বর্মী সৈন্যরা মসজিদ ও বাড়িঘর ধ্বংস করে এবং জমি-জমা দখল করে নেয়। মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে ওই অঞ্চলের সেনানিবাসের অভ্যন্তরের রাস্তা নির্মাণ করা হয়। এ সময় গণ-দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরের বছর এসব উদ্বাস্তুর অনেকেই আবার দেশে ফিরে যায়।
১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে বহিষ্কারের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী আবার ‘অপারেশন পাই থায়া’ বা ‘পরিষ্কার ও সুন্দর জাতি অপারেশন’ নামে দ্বিতীয় অভিযান শুরু করে। ২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আবার বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। পর্যাপ্ত খাদ্য ও ঔষধ ছাড়াই ৩ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশের অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছে। স্থানীয় জনসমাজে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক বোঝা, গ্রামে সামাজিক ঝামেলা ও ইসলামী জঙ্গিবাদের প্রজননকারী বলে মনে করে।
এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোও তাদের প্রতি কোনো সহানুভূতি প্রদর্শন করে না। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে রোহিঙ্গা ‘বোট পিপল’দের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে সাগরে ভাসতে থাকা, থাই নৌবাহিনীর গুলির শিকার, থাই নৌবাহিনীর হাতে আটক ও পরে মানুষ পাচারকারীদের কাছে বিক্রি, অথবা অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন কেন্দ্রগুলোতে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক থাকা, অসহায়ভাবে অনিশ্চিত জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করা ইত্যাদি।
মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গারা অব্যাহতভাবে পরিচয়হীনতার শিকার হচ্ছে। ১৯৮২ সালের নাগরিক আইনে সরকারিভাবে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়। যেহেতু তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নেই সে কারণে গ্রামের বাইরে যেতে, মসজিদ মেরামত করতে, ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে, এমনকি সন্তান নিতেও তাদের সরকারের কাছ থেকে পারমিট নিতে হয়। পারমিট না নিলেই গ্রেফতার ও জেল। এ পারমিট নিতে লাগে ঘুষ যে অর্থ সবার পক্ষে দেয়া সম্ভব হয় না।
১৯৯৪ সালে এক স্থানীয় আইন বলে রোহিঙ্গাদের দুটির বেশি সন্তান নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়। বহু রোহিঙ্গাকে জোর করে নির্মাণ কাজে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয় যা শুধু দাসপ্রথার সাথেই তুলনা করা যেতে পারে। তাদের বর্মী বসতকারীদের জন্য বাড়ি নির্মাণের কাজে লাগানো হয় যারা রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদকৃত স্থানেই বসতি স্থাপন করে। স্থানীয় বর্মী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা নারীদের পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত হতে বাধ্য করে বলেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
২০১২ সালে রাখাইন বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত হয়। এতে সরকারি হিসাবে ১৯২ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হলেও রোহিঙ্গা মানবাধিকার গ্রুপের মতে, নিহতের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। বৌদ্ধরা পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। ১ লাখ ২৫ হাজার লোক স্থানচ্যুত হয়। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এ ঘটনার পর বলেন, মিয়ানমার সরকারের চোখে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তিনি গোটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অন্য কোনো দেশে পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘ উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনারের কাছে তাদের সমর্পণের প্রস্তাব দেন। এরপর মান্দালয়ের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেও প্রেসিডেন্টের সমর্থনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
মিয়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘৯৬৯’ সংগঠনের নামে এক আন্দোলন শুরু করেছে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন মান্দালয়ের এক মঠের প্রধান ভিক্ষু উগ্র সাম্প্রদায়িক নেতা ইউ উইরাথু। তিনি স্থানীয় বৌদ্ধদের জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণায় উদ্দীপ্ত হয়ে মুসলমানদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি তাদের দোকানপাট বর্জনের জন্য উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারে ইসলাম বা মুসলমানের কোনো স্থান নেই। যাদের দোকানে ৯৬৯ নম্বর লেখা আছে শুধু তাদের দোকান ব্যবহার করতে বলেন। ২০১২ সালে মধ্য মিয়ানমারের মেইকটিলায় ৯৬৯ সংগঠনের অনুসারী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উস্কানিতে সংঘটিত দাঙ্গায় মুসলমানদের ১ হাজার ৩শ’ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। ৪৩ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়। এ বছর সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সরকারের স্বীকৃত ১৩৫টি জাতি-গোষ্ঠীর একটি ও দেশের বৈধ নাগরিক রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত ‘কামান’ মুসলিমদের ওপর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তুচ্ছ ঘটনায় হামলা চালায় ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
মিয়ানমারের নোবেল জয়ী গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরদ্ধে সহিংসতার নিন্দা করলেও রোহিঙ্গাদের দুর্দশার বিষয়ে নীরব। ২০১২ সালে বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বারবার তিনি তাদের ‘বাঙালি’ বলে উল্লেখ করেন।
মিয়ানমার ও বাইরে রোহিঙ্গাদের অনিঃশেষ দুর্দশা, পাশাপাশি সমগ্র মিয়ানমারে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিস্তৃতি সে দেশে কোনো গণতান্ত্রিক সংস্কারকে ব্যাহত করছে। গত ৫০ বছর ধরে চলে আসা এ সহিংসতার এখন আরো অবনতি ঘটেছে এবং নতুন নতুন গোষ্ঠীর মধ্যে তা বিস্তার লাভ করছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের এখন যা করা প্রয়োজন তা হলো মানবাধিকার ও বহুত্ববাদীতার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ, সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আইনের শাসনের উন্নয়ন করে তৃণমূলে পৌঁছে দেয়া, রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বের স্বীকৃতিসহ তাদের দুর্দশা লাঘবের ব্যবস্থা নেয়া। তাহলেই শুধু আন্তর্জাতিক সমাজ ও নিজের জনগণের কাছে গণতান্ত্রিক মিয়ানমার বৈধতার স্বীকৃতি পেতে পারে।
রোহিঙ্গারা ছিল ঐতিহাসিক আরাকান রাজ্যের অধিবাসী। ১৯৪৮ সালে বার্মা ইংরেজ শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এ সময় সীমান্তবর্তী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে আরাকান রাজ্যের যোগদানের আলোচনা সত্ত্বেও তা বার্মার অংশ হিসেবেই থেকে যায়। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে সামরিক জান্তা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বর্মী ও বৌদ্ধ হিসেবে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে। এটা ছিল মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতা অং সান-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পৃথক। অং সান ১৯৪৭ সালে ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার আগে তার স্বল্পমেয়াদি অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী কমিটিতে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে আরাকান রাজ্যের নাম পাল্টে রাখাইন প্রদেশ করা হয়। একই সময়ে বার্মার নামকরণ করা হয় মিয়ানমার।
মুসলিম রোহিঙ্গারা অবর্মি ও অবৌদ্ধ। তাদের বিদেশী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শুধু তাই নয়, তাদের ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মায় এসে বসতি স্থাপনকারী ‘অবৈধ বাঙালি অভিবাসী’ বলা হয় যা সঠিক নয়। সত্তর দশকের শুরুর দিকে বর্মী সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জাতিকে জাতিগোষ্ঠীগতভাবে নির্মূলের অভিযান শুরু করে। প্রথম দিকের এ ধরনের একটি অপারেশনের নাম ছিল নাগা মিন বা কিং ড্রাগন। বার্মায় কথিত ‘অবৈধ অভিবাসী’ চিহ্নিত ও তাদের বহিষ্কার করার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে এ অপারেশন পরিচালনা করা হয়। কিং ড্রাগনের প্রতীক বৌদ্ধ পুরাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘বিদেশী’দের কথিত ‘হুমকি’ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্রতা রক্ষায় সামরিক বাহিনীর ব্যাপকভিত্তিক জাতিগোষ্ঠীগত নির্মূল অভিযানের প্রথম পদক্ষেপ ছিল পরিচয় যাচাই। এ অভিযান চলাকালে রোহিঙ্গারা ব্যাপকভিত্তিক ধর্ষণ, নির্বিচার গ্রেফতারের শিকার হয়। বর্মী সৈন্যরা মসজিদ ও বাড়িঘর ধ্বংস করে এবং জমি-জমা দখল করে নেয়। মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে ওই অঞ্চলের সেনানিবাসের অভ্যন্তরের রাস্তা নির্মাণ করা হয়। এ সময় গণ-দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরের বছর এসব উদ্বাস্তুর অনেকেই আবার দেশে ফিরে যায়।
১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে বহিষ্কারের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী আবার ‘অপারেশন পাই থায়া’ বা ‘পরিষ্কার ও সুন্দর জাতি অপারেশন’ নামে দ্বিতীয় অভিযান শুরু করে। ২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আবার বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। পর্যাপ্ত খাদ্য ও ঔষধ ছাড়াই ৩ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশের অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছে। স্থানীয় জনসমাজে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক বোঝা, গ্রামে সামাজিক ঝামেলা ও ইসলামী জঙ্গিবাদের প্রজননকারী বলে মনে করে।
এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোও তাদের প্রতি কোনো সহানুভূতি প্রদর্শন করে না। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে রোহিঙ্গা ‘বোট পিপল’দের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে সাগরে ভাসতে থাকা, থাই নৌবাহিনীর গুলির শিকার, থাই নৌবাহিনীর হাতে আটক ও পরে মানুষ পাচারকারীদের কাছে বিক্রি, অথবা অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন কেন্দ্রগুলোতে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক থাকা, অসহায়ভাবে অনিশ্চিত জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করা ইত্যাদি।
মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গারা অব্যাহতভাবে পরিচয়হীনতার শিকার হচ্ছে। ১৯৮২ সালের নাগরিক আইনে সরকারিভাবে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়। যেহেতু তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নেই সে কারণে গ্রামের বাইরে যেতে, মসজিদ মেরামত করতে, ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে, এমনকি সন্তান নিতেও তাদের সরকারের কাছ থেকে পারমিট নিতে হয়। পারমিট না নিলেই গ্রেফতার ও জেল। এ পারমিট নিতে লাগে ঘুষ যে অর্থ সবার পক্ষে দেয়া সম্ভব হয় না।
১৯৯৪ সালে এক স্থানীয় আইন বলে রোহিঙ্গাদের দুটির বেশি সন্তান নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়। বহু রোহিঙ্গাকে জোর করে নির্মাণ কাজে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয় যা শুধু দাসপ্রথার সাথেই তুলনা করা যেতে পারে। তাদের বর্মী বসতকারীদের জন্য বাড়ি নির্মাণের কাজে লাগানো হয় যারা রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদকৃত স্থানেই বসতি স্থাপন করে। স্থানীয় বর্মী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা নারীদের পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত হতে বাধ্য করে বলেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
২০১২ সালে রাখাইন বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত হয়। এতে সরকারি হিসাবে ১৯২ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হলেও রোহিঙ্গা মানবাধিকার গ্রুপের মতে, নিহতের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। বৌদ্ধরা পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। ১ লাখ ২৫ হাজার লোক স্থানচ্যুত হয়। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এ ঘটনার পর বলেন, মিয়ানমার সরকারের চোখে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তিনি গোটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অন্য কোনো দেশে পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘ উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনারের কাছে তাদের সমর্পণের প্রস্তাব দেন। এরপর মান্দালয়ের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেও প্রেসিডেন্টের সমর্থনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
মিয়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘৯৬৯’ সংগঠনের নামে এক আন্দোলন শুরু করেছে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন মান্দালয়ের এক মঠের প্রধান ভিক্ষু উগ্র সাম্প্রদায়িক নেতা ইউ উইরাথু। তিনি স্থানীয় বৌদ্ধদের জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণায় উদ্দীপ্ত হয়ে মুসলমানদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি তাদের দোকানপাট বর্জনের জন্য উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারে ইসলাম বা মুসলমানের কোনো স্থান নেই। যাদের দোকানে ৯৬৯ নম্বর লেখা আছে শুধু তাদের দোকান ব্যবহার করতে বলেন। ২০১২ সালে মধ্য মিয়ানমারের মেইকটিলায় ৯৬৯ সংগঠনের অনুসারী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উস্কানিতে সংঘটিত দাঙ্গায় মুসলমানদের ১ হাজার ৩শ’ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। ৪৩ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়। এ বছর সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সরকারের স্বীকৃত ১৩৫টি জাতি-গোষ্ঠীর একটি ও দেশের বৈধ নাগরিক রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত ‘কামান’ মুসলিমদের ওপর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তুচ্ছ ঘটনায় হামলা চালায় ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
মিয়ানমারের নোবেল জয়ী গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরদ্ধে সহিংসতার নিন্দা করলেও রোহিঙ্গাদের দুর্দশার বিষয়ে নীরব। ২০১২ সালে বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বারবার তিনি তাদের ‘বাঙালি’ বলে উল্লেখ করেন।
মিয়ানমার ও বাইরে রোহিঙ্গাদের অনিঃশেষ দুর্দশা, পাশাপাশি সমগ্র মিয়ানমারে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিস্তৃতি সে দেশে কোনো গণতান্ত্রিক সংস্কারকে ব্যাহত করছে। গত ৫০ বছর ধরে চলে আসা এ সহিংসতার এখন আরো অবনতি ঘটেছে এবং নতুন নতুন গোষ্ঠীর মধ্যে তা বিস্তার লাভ করছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের এখন যা করা প্রয়োজন তা হলো মানবাধিকার ও বহুত্ববাদীতার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ, সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আইনের শাসনের উন্নয়ন করে তৃণমূলে পৌঁছে দেয়া, রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বের স্বীকৃতিসহ তাদের দুর্দশা লাঘবের ব্যবস্থা নেয়া। তাহলেই শুধু আন্তর্জাতিক সমাজ ও নিজের জনগণের কাছে গণতান্ত্রিক মিয়ানমার বৈধতার স্বীকৃতি পেতে পারে।