সংস্কৃতি বর্ণ ও পরিবার নিয়ে তিন নওমুসলিমের নারীর অভিজ্ঞতা

Womenপ্রতিবছর অন্তত ৫ হাজার ব্রিটিশ ইসলামে ধর্মান্তরিত হন। এদের বেশিরভাগই নারী। এদেরই পাঁচজনের গল্প নিয়ে সম্প্রতি ব্রিটিশ দৈনিক দ্যা গার্ডিয়ানে ‘কনভার্টিং টু ইসলাম: ব্রিটিশ ওমেন অন প্রেয়ার, পিস অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এই শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
নিবন্ধটিতে বর্ণিত তাদের ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনাগুলো থেকে পশ্চিমা সমাজে ঘটে চলা এক নীরব পরিবর্তনের একটি বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর বর্ণ ও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তিন নওমুসলিমের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হলো:
ড. এ্যানি (আমিনা) কক্সন (৭২) । পেশায় কনসালটেন্ট ফিজিশিয়ান এবং নিউরোলজিস্ট। লন্ডনের বাসিন্দা এ্যানি বলেন, বংশগতির দিক থেকে আমি একজন নর্ম্যান ইংরেজ। আমার শৈশবের একটা বড় অংশ কেটেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং মিসরে।
ছয় বছর বয়সে আমি যুক্তরাজ্যের একটি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হই। এরপর আমি লন্ডন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মেডিকেল প্রশিক্ষণ নিই। আমি দুবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। আমার তিনটি সৎ-সন্তান এবং পাঁচটি সৎ-নাতী-নাতনী আছে। আমি ইসলামে ধর্মান্তরিত হই ২১ বছর আগে। ক্যাথলিকবাদের চেয়েও আরো বেশি পরমার্থিক বা আধ্যাত্মিক (স্পিরিচুয়াল) একটি ধর্মের অনুসন্ধান করতে গিয়েই আমি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হই। ইসলাম সম্পর্কে গণমাধ্যমের নেতিবাচক প্রচারণার ফলে প্রথমদিকে এর প্রতি আমি তেমন কোনো আকর্ষণ বোধ করিনি।
আমার ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে এগোয়। সবশেষে আমি ওমানের বর্তমান সুলতানের মায়ের দেখানো কিছু নজির দ্বারা পথের দিশা পাই। তিনি আমার একজন নিয়মিত রোগী ছিলেন। এছাড়া ধারাবাহিকভাবে কিছু স্বপ্নের মাধ্যমেও আমি পথ নির্দেশিত হই।
প্রথমে আমার পরিবার খুবই বিস্মিত হয়। তবে তারা আমার ধর্মান্তর হওয়াকে মেনে নেয়। কিন্তু ৯/১১ এর পর আমার ননদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। তাদের বাড়িতে আমি আর আগের মতো নন্দিত নই। আমার কিছু বন্ধু ছিল যারা আমার ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টিকে একটি গ্রহণযোগ্য খামখেয়ালিপনা মনে করতো। তবে এর জন্য আমি ঘনিষ্ঠ নয় এমন আরো অনেক বন্ধুকেই হারাই।
আমি যখন ধর্মান্তরিত হই তখন ইমাম সাহেব আমাকে বলেন, আমাকে অবশ্যই শালীন পোশাক পরতে হবে। হিজাব না পরলেও চলবে, কারণ আমি ইতোমধ্যেই বয়োবৃদ্ধ হয়ে গেছি। রমজান মাসে আমি আমার রোগীদের সতর্ক করে বলে দিই, মসজিদ থেকে ফেরার সময় আমাকে একটু ভিন্ন রকম দেখাবে। এতে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তারা, বরং বিস্ময় প্রকাশ করে।
আমি বিভিন্ন ইসলামী কমিউনিটিতে যোগ দেয়ার চেষ্টা করি, যেমন- তুর্কি, পাকিস্তানি এবং মরোক্কীয়। আমি এক মরোক্কীয় মসজিদে তিন বছর ধরে যাতায়াত করি। কিন্তু এই তিন বছরের কোনো ঈদেই একজন লোকও আমাকে ‘ঈদ মোবারক’ বলে শুভেচ্ছা জানায়নি। আমার ক্যান্সার হয়েছিল। কিন্তু নয় মাসের চিকিৎসাকালীন সময়ে আমার কোনো মুসলিম বন্ধুই (খুবই পবিত্র এক বৃদ্ধ ছাড়া) আমার সঙ্গে প্রার্থনা করতে আসেনি।
কিন্তু ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে আমি যে স্থিরতা, প্রজ্ঞা এবং শান্তির সন্ধান পেয়েছি সেসবের তুলনায় এসব ছোট খাটো যন্ত্রণা একদমই তুচ্ছ। অবশেষে আমি আমার নিজের মুসলিম কমিউনিটি খুঁজে পেয়েছি, আর সেটা হলো আফ্রিকান মুসলিম কমিউনিটি। অনেক মুসলিমই লন্ডনে অভিবাসী হয়ে আসেন। তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ভিন্ন ভিন্ন মসজিদের সঙ্গেই বাঁধা থাকে এবং সেসব মসজিদে তারা সাদাদের মুখ দেখতে চান না। তবে এক্ষেত্রে আমি যে আফ্রিকান মুসলিম কমিউনিটিটিতে যোগ দিই তারা একদমই ব্যতিক্রম ছিল। একটা সময় আসবে যখন সাদা চামড়ার ধর্মান্তরিতদের আর উদ্ভট ভাবা হবে না।
ক্রিস্টিন বেকার (৪৭)। পেশায় টেভি উপস্থাপিকা। লন্ডনের বাসিন্দা বেকার বলেন, জার্মানির এক প্রটেস্ট্যান্ট খৃস্টান পরিবারে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আমার পরিবার তেমন একটা ধর্মকর্ম করতো না। ১৯৮৯ সালে আমি এমটিভি ইউরোপে কাজ করার জন্য লন্ডনে চলে আসি। আমি প্রচুর পরশ্রিম করি। কিন্তু আমার ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা বিরাজ করতো।
এভাবে একটা সময় আমি ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের সঙ্গে পরিচিত হই। তিনি আমাকে ইসলামের ওপর লিখিত একটি বই দেন এবং আমাকে তার সঙ্গে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান। ওই সফর আমার জীবনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটায় এবং আমার মধ্যে মনুষ্য জীবনের পরমার্থিকতা বা আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে এক নতুন সচেতনতা তৈরি করে। ওই সফরে আমি যেসব মুসলিমদের সঙ্গে মিলিত হই তাদের মমতা, মর্যাদাবোধ এবং অন্যের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার প্রবণতা আমার অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। আমি ইসলাম সম্পর্কে যতই পড়াশোনা করতে লাগলাম ততই ইসলাম আমাকে আরো বেশি আকৃষ্ট করতে লাগলো। অবশেষে ১৯৯৫ সালে আমি ইসলামে ধর্মান্তরিত হই। জার্মান গণমাধ্যম যখন এ খবর জানতে পারলো, তারা আমার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ নেতিবাচক প্রচারণা শুরু করলো। এমটিভি ইউরোপ আমার সঙ্গে করা কাজের চুক্তি বাতিল করে দেয়। সেখানেই আমার বিনোদন জগতের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। নতুন ধর্মের মূল্যবোধের সঙ্গে আমার টেলিভিশন ক্যারিয়ারের সামঞ্জস্য বিধান খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। বর্তমানে আমি একটি মুসলিম সংস্কৃতি এবং লাইফ স্টাইল শোতে কাজ করি। আমি অনুভব করি যে, ঐতিহ্যগত মুসলিম কমিউনিটি এবং সমাজের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে একটি ভূমিকা রয়েছে আমার। বেশিরভাগ মুসলিম নারীই খুব অল্প বয়সেই বিয়ে করেন। এক্ষেত্রে তাদের পরিবারগুলোই তাদের সহায়তা করে থাকে। আমি ধর্মান্তরিত হই ৩০ বছর বয়সে। কিন্তু এরপরও আরো ১০ বছর পর্যন্ত আমি অবিবাহিত থাকি। অবশেষে আমি অনলাইনে সঙ্গী খোঁজার চেষ্টা করি। সেখানে আমি মরোক্কো বংশোদ্ভূত এক অসাধারণ মুসলিম পুরুষের প্রেমে পড়ি। তিনি পেশায় একজন টেলিভিশন প্রডিউসার ছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বসবাস করতেন। আমাদের মধ্যে অনেক বিষয়েই দারুণ মিল ছিল। ২০০৬ সালে আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই।
কিন্তু ইসলামকে তিনি যেভাবে ব্যাখ্যা করতেন তা আমার জন্য ক্রমেই পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে এবং আমার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। তিনি আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলেন। অন্য পুরুষদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেন। এমনকি আমার ছবির এ্যালবাম থেকে অন্য পুরুষদের ছবি কেটে ফেলতে আদেশ দেন।
আমর উচিত ছিল তখনই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। কারণ, তিনি যেসব দাবি করেন সেগুলো যতটানা ইসলামী ছিল, তার চেয়ে বরং অনেক বেশি বিশেষ সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল। কিন্তু এরপরও আমি বিয়েটা ভাঙতে চাইনি। তবে শেষ রক্ষা আর হয়নি। বর্তমানে আমি আরো নির্ভরযোগ্য একজন মুসলিম স্বামী খুঁজছি। যিনি বাইরের শৃঙ্খলের চেয়ে, বরং ইসলামের মর্মগত দিকগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দেবেন।
ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে আমার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। বিপরীতে আমি বরং শান্তিতেই আছি। আমার জীবনের এখন একটা অর্থ আছে। আর তা খুবই অমূল্য সম্পদ। আন্দ্রেয়া চিশতী  (৪৭)। পেশায় একজন রিফ্লেক্সোলজিস্ট এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওয়ার্টফোর্ডের এই বাসিন্দা বলেন, আমি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক মুসলিমের সঙ্গে ১৮ বছর ধরে খুব সুখেই ঘর-সংসার করছি। আমাদের ১১ বছর বয়সী একটি ছেলে এবং ৮ বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। ফিদার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯১ সালে। ইসলাম সম্পর্কে আমার আগ্রহ ছিল প্রেম এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণাসমূহের একটি সমন্বয়। ফিদা একটি মুসলিম পরিবার চেয়েছিল। এদিকে ১৯৯২ সালের মধ্যেই ইসলামের প্রতি আমার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। ফলে আমি ধর্মান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এর তিন বছর পর আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। বিয়ের আগের সময়টাতে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে লড়াই করি। বন্ধু-বান্ধব এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হই। সিদ্ধান্ত নিই কীভাবে আমরা একসঙ্গে বাস করবো।
আমি জার্মানিতে বড় হয়েছি। আমাদের পরিবারে ধর্মকর্মের তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা ছিল না। আমার বাবা ছিলেন নাস্তিক। কিন্তু আমার মা এবং বিদ্যালয় আমাকে এ বিষয়ে একটি দৃঢ় বিশ্বাস দান করে যে, পরমার্থিকতা বা আধ্যাত্মিকতা (স্পিরিচুয়ালিটি) মনুষ্য জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
আমি যখন ধর্মান্তরিত হই তখন আমার বাবা এটাকে একটা পাগলামি ভেবেছিলেন। কিন্তু তিনি আমার স্বামীকে পছন্দ করেন। এমনকি তিনি আমার জন্য একটি ছোট ফ্ল্যাটও কিনে দেন, যেন আমরা চাইলেই তাদের কাছে বেড়াতে আসতে পারি। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে আমার মা কষ্ট পান এবং এমনকি তিনি আতঙ্কিতও হয়ে পড়েন।
আমরা পাকিস্তানের গতানুগতিক নিয়মানুযায়ীই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। ফিদার ছিল এক বিশাল পরিবার। বিয়ের পর আমি অন্য দেশে চলে যাই। ফলে তাকে একা একাই অনেক কিছুর মোকাবিলা করতে হয়। তার পরিবার একদমই সুখী ছিল না। তারা বরং চেয়েছিল একজন মুসলিম ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা মুসলিমের সঙ্গেই ফিদার বিয়ে হোক। আমি মনে করি না যে, আমাকে আগের চেয়ে ভিন্নভাবে পোশাক পরতে হবে। আমি মনে করি না যে, আমাকে সব সময়ই হিজাব পরে থাকতে হবে। কিন্তু ঘরের বাইরে বের হলে এবং ধর্মকর্ম করার সময় আমি হিজাব পরে থাকতেই আরাম বোধ করি। আমি আমার মায়ের কারণেও সবসময় হিজাব পরি না। কারণ তার কাছে এটা খুবই বড় একটা বিষয়।
কৈশোরে আমি খুবই সংবেদনশীল ছিলাম। আমি কখনই মদপান করতাম না। আমি একজন শিক্ষক। সুতরাং আমি কখনই পুরোনো জীবন পুরোপুরি ত্যাগ করে নতুন জীবনের সন্ধান করিনি। কিন্তু ইসলাম আমার নীতি-নৈতিকতা বোধকে আরো শক্তিশালী করেছে এবং আমাদের পারিবারিক জীবনের জন্য একটি শক্ত ভিত্তিমূল স্থাপন করেছে। তোমার নিজেকে প্রায়ই একটি ‘টফির’ মতো মনে হবে, কারণ তুমি সাদা চামড়ার মানুষ। যদি তুমি ভিড়ের মধ্যে যাও সবাই তোমাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসবে, তোমাকে শিখিয়ে দিতে আসবে এবং তোমাকে তাদের দলে বেড়াতে চাইবে। এসব আমার খুবই বিরক্ত লাগতো। কিন্তু ধর্মান্তরিত সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর বেশিরভাগই মানবিক এবং নারী বিষয়ক সমস্যা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button