কওমী মাদ্রাসার বিষয়ে সরকারের শুভ বুদ্ধি
‘বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৩’ সংক্রান্ত আইনের প্রস্তাব প্রত্যাহার করিয়া সরকার গতকাল সোমবার যে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়াছেন তাহা প্রশংসার যোগ্য। মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকে খসড়া আইনের বিবেচিত বিষয়ের (অ্যাজেন্ডা) তালিকা হইতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই আইনের প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করিয়া নেয়।
সময় থাকিতে সরকার এই দূরদৃষ্টির পরিচয় না দিলে কওমী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণরূপ এই প্রস্তাবিত আইনটি লইয়া যে জটিলতা সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহা আরও ভয়াবহ হইতে পারিত। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী গত রবিবার স্পষ্টতই সরকারের এইরূপ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করিয়াছিলেন—এই আইন পাস হইলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হইবে। তাহার যুক্তি ছিল—প্রস্তাবিত এই আইনের মাধ্যমে কওমী মাদ্রাসাসমূহে বিদ্যমান ইসলামী শিক্ষার স্বকীয়তা ধ্বংস, সমাজকে ধর্মহীন ও নৈতিকতা শূন্য করিবার কু-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইয়াছে—সুতরাং এইরূপ আইন তথা সরকারি নিয়ন্ত্রণ মানিয়া লইবার কোনো কারণ নাই। তাহা ছাড়া ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের স্বতস্ফূর্ত সার্বিক সহযোগিতায় পরিচালিত কওমী মাদ্রাসাসমূহকে সরকার এই আইনের সুবাদে নিজেদের মনোনীত কিছু লোক চাপাইয়া দেওয়ার মাধ্যমে বস্তুত কওমী মাদ্রাসাগুলির ওপর খবরদারি নিশ্চিত করিতে চায়। সনদের তথাকথিত স্বীকৃতির নাম করিয়া আলেমদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টিরও গভীর চক্রান্তের কথা তাহারা জানাইয়াছেন। গত রবিবার এই সম্পাদকীয় কলামে আমরাও স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছি—কওমী মাদ্রাসার স্বীকৃতি চাই, নিয়ন্ত্রণ নহে। ‘কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা হইয়াছিল গত বত্সর ১৫ এপ্রিল। কমিশনের সুপারিশের আলোকে তৈরি করা আলোচ্য আইনের খসড়ার ধারা-উপধারা লইয়া সরকারের আরও গভীরভাবে অনুধাবন করিবার দরকার ছিল। কেননা ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত আইনটির খসড়া প্রকাশের পরই এই ব্যাপারে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হইয়াছিল এবং প্রতিবাদের ঢেউ যেইভাবে উচ্চতা বাড়াইতেছিল, তাহাতে সরকারকে আরও পূর্বেই অধিক সচেতন হওয়ার প্রয়োজন ছিল বৈকি। তাহার পরও পানি বেশি দূর গড়াইবার পূর্বেই যে সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হইয়াছে, তাহাই স্বস্তির। কেননা যুগের পর যুগ ধরিয়া প্রবহমান শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর হঠাত্ নিয়ন্ত্রণমূলক কোনো আইন হিতে বিপরীত হইতে পারিত বটে; অন্তত সেই আইনকে যখন এই কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার স্বকীয়তা ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধ্বংসরূপে প্রতীয়মান করা হইয়াছে।
কওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির দাবির বিপরীতে আইন করিয়া সরকার যেইভাবে তাহার নিয়ন্ত্রণ লইতে চাহিয়াছিল—তাহা সুবুদ্ধির পরিচায়ক ছিল না। এই স্বীকৃতির দাবি যে অন্যায্য বা বিরল—তাহাও নহে। কেননা ভারত ও পাকিস্তানে কওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি আছে, কিন্তু কোনোরূপ সরকারি নিয়ন্ত্রণ নাই। সুতরাং বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসা মহলের এইরূপ দাবি অবাস্তব কেন হইবে? পাশাপাশি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিতে ১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারী কওমী মাদ্রাসার স্বকীয়তা ধরিয়া রাখাই বাঞ্ছনীয়। স্মরণ করা যাইতে পারে যে, ব্রিটিশ আমলে এই মাদ্রাসাগুলিকে বলা হইত ‘খারিজি মাদ্রাসা’, যাহার অর্থ—সরকারি নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত।
সুতরাং এই বিতর্কিত আইন প্রণয়ন হইতে সরিয়া আসিয়া সরকার শেষ মুহূর্তে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বতন্ত্র মূল্যবোধের প্রতিই সম্মান প্রদর্শন করিয়াছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই আইনের প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করিয়া আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পরবর্তীতে মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করিবার পরিকল্পনা করিয়াছে। এই পরিকল্পনার ব্যাপারেও সরকার ভবিষ্যতে তাত্পর্যপূর্ণ ও বাস্তবোচিত চিন্তা ভাবনার পরিচয় প্রদর্শন করিবে—এমন আশা করা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হইবে না। -দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় থেকে