অধিকৃত ভূখন্ডে বসতি নির্মাণ : ইইউ’-ইসরাইল টানাপোড়েন
ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূখন্ডে ইহুদি বসতি বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন নির্দেশনা নিয়ে ইহুদি রাষ্ট্রটির সাথে ইইউ’র সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। ইসরাইলের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে টানাপোড়নের আশংকাটি স্পষ্ট ব্যক্ত করা হয়। রয়টার্সের সাথে এক সাক্ষাৎকারে জীভ ইলকিন ইইউকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে বলেন, ইইউ যদি নতুন নির্দেশনার ব্যাপারে ইসরাইলের সাথে সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হয় তাহলে ইসরাইলের সাথে তাদের গবেষণা এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের অবনতি হতে পারে।
উল্লেখ্য, ফিলিস্তিনী জনগণের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিগত সমর্থন থাকলেও শুধুমাত্র ইসরাইলের অসহযোগিতার কারণে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। ইসরাইল আন্তর্জাতিক নীতিমালা এবং ফিলিস্তিনীদের অব্যাহত আপত্তি উপেক্ষা করে অধিকৃত ভূখন্ডে ইহুদি বসতি স্থাপন করেই যাচ্ছে, যা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার পথেও প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।
শান্তি প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নে আগামী নবেম্বরের শেষ নাগাদ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা। এই লক্ষ্যে অধিকৃত ভূখন্ডে ইহুদি বসতি স্থাপন থেকে বিরত থাকতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ ইসরাইলকে বার বার নির্দেশনা প্রদান করলেও ইহুদি রাষ্ট্রটি বরাবরই তা অগ্রাহ্য করে আসছে। সর্বশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন নির্দেশনা পালনেও তারা শুধু যে গড়িমসি করছে তাই নয়, উল্টো সম্পর্কের অবনতির হুমকিও দিচ্ছে।
ইসরাইলি কর্মকর্তা বলেন, সম্পর্কের অবনতি হলে ইসরাইলের বিজ্ঞানিরা তহবিল থেকে বঞ্চিত হবে; তবে একইভাবে ইউরোপও ইসরাইলের স্বীকৃতি হারাবে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি এই সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হই তাহলে ভবিষ্যতে ইসরাইল ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বয়কট করবে।
উল্লেখ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গবেষণা প্রকল্পের ব্যাপারে ইসরাইলের সাথে চুক্তি করতে যাচ্ছে। হরাইজন নামের এই প্রকল্পটি ২০২০ সাল নাগাদ বাস্তবায়িত হতে পারে। ইসরাইল এই প্রকল্পটির প্রতিই ইঙ্গিত করে তা বর্জনের হুমকি দিচ্ছে। এই ইহুদি কর্মকর্তা ইইউকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আমরা একটি প্রতিষ্ঠিত জাতি, আমাদেরকে হারানো হবে ইউরোপের একটি বড় ভুল।’
উল্লেখ্য, চলতি সপ্তায় ইইউ’র একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ইসরাইল সফর করে ইসরাইলের সাথে এবং দেশটির প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির সাথে সম্পর্ক জোরদার করার অঙ্গীকার করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক সত্ত্বেও এই ইহুদি রাষ্ট্রটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অংশীদার। গত মাসে ইইউ’র মোট আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের এক তৃতীয়াংশ সম্পাদিত হয়েছে ইসরাইলের সাথে।
বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছাড়াও ইসরাইলের সাথে ইউরোপের গভীর ঐতিহাসিক যোগসূত্রও রয়েছে। তা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ায় ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক ভূমিকায় অস্বস্তিতে রয়েছে ইউরোপ। তারা ইহুদি রাষ্ট্রটির প্রতি সমালোচনামূখর হয়ে উঠছে। বলছে, ইসরাইল ফিলিস্তিনীদের সাথে শান্তির সুযোগকে নষ্ট করছে।
ইসরাইল-ইইউ’র মধ্যকার টানাপোড়নের বিষয়টি বিশেষভাবে দৃষ্টিগোচর হয় গত জুলাইতে, যখন ইইউ’র নির্বাহী পরিষদ ঘোষণা করে যে, ২০১৪ সাল থেকে পশ্চিম তীরে কর্মরত প্রতিটি ইসরাইলী সংস্থার উপর অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়া হবে। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয় ইসরাইল।
জেরুসালেমে ইইউ’র একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইসরাইল ইইউ’র কূটনৈতিক ভাষা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই তারা এই নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে। এই সিদ্ধান্তের পর ইসরাইলের উদ্যত কন্ঠ একটু নীচু হলেও ইলকিনের হুমকি তাদের পুরনো চেহারাই আবার প্রকাশ পেলো।
উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালে জোরপূর্বক ফিলিস্তিনী ভূখ- দখল করে নেয় ইসরাইল। এরপর থেকে অধিকৃত ভূখন্ডে পাঁচ লাখেরও বেশি ইহুদি বসতি নির্মাণ করা হয়।
অধিকৃত ভূখন্ডে ইহুদি বসতি নির্মাণের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন নির্দেশনা প্রকাশের পর ইসরাইল ইউরোপীয় কূটনীতিকদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। জবাবে ইইউ বলে, অবৈধ বসতি বাড়ানোর মাধ্যমে ইউরোপীয়দের হতাশ করেছে ইসরাইল।
উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপের প্রভাব কম। তারপরও ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ইউরোপই প্রথম যুগান্তরকারী কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে যা পরবর্তীতে অন্যরা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৮০ সালে ইউরোপই প্রথম ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাতের প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন- (পিএলও) কে সমর্থন প্রদান করে যা পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্য দেশগুলো অনুসরণ করে।
নতুন নির্দেশনা বিষয়ে ইইউ বলেছে, নির্দেশনাতে আর কোন পরিবর্তন আনা হবে না, তবে তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে সহজতর করা হতে পারে। তবে এ বিষয়ে ইসরাইলের সাথে আলোচনায় কোন অগ্রগতি হয়নি বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট একজন ইইউ কর্মকর্তা।
চলতি সপ্তায় ইইউ’র শিল্প বিষয়ক কমিশনার এ্যান্টনিও টাজানি ৬০ সদস্যের ব্যবসায়ী সদস্য সহ ইসরাইল সফর করেন। তিনি বলেন, অবশ্যই কিছু সমস্যা রয়ে গেছে, তবে আমরা ইসরাইলের সাথে কাজ করতে চাই।
এ প্রসঙ্গে একজন ইসরাইলী কর্মকর্তা বলেন, ইউরোপিয়ানরা আমাদেরকে উদ্বিগ্ন না হতে বলেছেন, কিন্তু আমরা উদ্বিগ্ন, কারণ আমরা ইহুদি।’