ফরহাদ মজহারের বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে : গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা
ফরহাদ মজহারের বক্তব্য বিকৃত করে প্রকাশ করা হয়েছে বলে গোলটেবিল আলোচনা সভায় বক্তারা দাবি করেছেন। ফরহাদ মজহারও তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। শনিবার জাতীয় প্রেস কাব মিলনায়তনে ‘আক্রান্ত গণমাধ্যম : সংকটের আবর্তে দেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা সভায় বক্তারা এ দাবি করেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) এ গোলটেবিলের আয়োজন করে। সভায় ফরহাদ মজহার তার বক্তব্য বিকৃত করার অভিযোগ তুলে এর তীব্র নিন্দা জানান।
তিনি বলেন, একটি বিতর্কিত টেলিভিশন মিডিয়া আমার বক্তব্য নিয়েছে। আমার বক্তব্যকে কাটছাট ও বিকৃত করে প্রচার করে আমাকে হেয় করার চেষ্টা করছে। সাংবাদিকদের বোমা মারার হুমকির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমি আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভিসহ বেশ কিছু মিডিয়ার সাথে যুক্ত ছিলাম। সেগুলো যখন বন্ধ হলো তখন চলুন আমরা সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা একসাথে হয়ে সব মিডিয়ার ওপর বোমা মারি। আমি যেহেতু মিডিয়া ও গণমাধ্যম কর্মী, আমি কখনো চাইবো না, মিডিয়ার ওপর বোমা হামলা। সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাকেও একইভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। মাহমুদুর রহমানের জামিন না দেয়ায় সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন তিনি।
জিডি ও সাংবাদিক নেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাকে যে গ্রেফতার ও মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয়েছে, তাতে আমি ভয় পাই না। মৃত্যুর ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। তথ্য বিকৃত করে হেয় করা আর হুমকি কোন ধরনের সাংবাদিকতা? তার বিরুদ্ধে অন্য অপপ্রচারেরও অভিযোগ তুলে এরও তীব্র নিন্দা জানান ফরহাদ মজহার। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মিজা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শুধু গণমাধ্যম নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্বই আজ আক্রান্ত। সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও কাজে কর্মে সম্পূর্ণ গণতন্ত্র বিরোধী। দেশের গণতন্ত্রকে কিভাবে ধ্বংস করা যায় তার সব কাজই করছে আওয়ামী লীগ সরকার। তারা পঁচাত্তরের মতো গত পাঁচ বছরে নানা ভয় দেখিয়ে সাংবাদিকদের হত্যা করে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বন্ধ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, বিনা অপরাধে মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে বন্দি করে রেখেছে। যে অপরাধে মাহমুদুর রহমানকে বন্দি রাখা হয়েছে একই অভিযোগে অভিযুক্ত বর্তমান তথ্যমন্ত্রী। তিনি অনুমতি না নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীর ফোনালাপ গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর এতে সায় ছিল। তাই প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত।
তিনি আরো বলেন, আমরা সংগ্রামে আছি। আমাদের মৌলিক অধিকার নির্বাচনকে দলীয় করছে সরকার। পাঁচ বছরে তারা জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে রসাতলে নিয়ে গেছেন। তাই সরকার নিজেদের অধীনে নির্বাচন দিয়ে আবার মতায় আসতে চায়।
ফরহাদ মজহার সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার অবাক লাগে, ফরহাদ মজহার এতো দেরিতে কেন আক্রান্ত হলেন। ফরহাদ মজহার একা নন, তার সাথে বিএনপিসহ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ রয়েছে। দেশের সচেতন মানুষ ফরহাদ মজহারের সাথে আছে। এই লড়াই বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা করার লড়াই। ১৯৭১-এ মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের আন্দোলনে অংশ নিয়ে এ লড়াই সংগ্রামে জয়লাভ করতে হবে।
সংবাদকর্মীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, যারা ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তারা সাগর-রুনিসহ প্রায় ১৭ জন সাংবাদিক হত্যার বিচার, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা টেলিভিশন বন্ধ, মাহমুদুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে তো কথা বলে না। তাই সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে দলমতের উর্ধ্বে থেকে কাজ করার আহবান জানান।
ড. আকবর আলী খান বলেন, দেশ আজ ক্রান্তিলগ্নে আছে। রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে গেছে। গত দুই দশক ধরে এদেশে রাজনৈতিক সংঘাত লেগেই আছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে এ সংঘাত নিরসন হবে না। বড় দুই জোটের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বড় দুই জোট নির্বাচনী ফর্মূলা নিয়ে বির্তক সৃষ্টি করছে। সংকটময় অবস্থা স্থায়ী হলে দেশ ও গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে। এ সংকটে দুই জোটকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের আহবান জানান তিনি। সিভিল সমাজের সমালোচনা করে তিনি বলেন, আজ সিভিল সমাজ রাজনীতির নামে দ্বিখণ্ডিত। এতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। ভেদাভেদ ভুলে নিবার্চন করার আহবান জানান তিনি।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, সংঘাত প্রধানমন্ত্রী সৃষ্টি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সরে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ফরহাদ মজহার সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীও তো প্রধানমন্ত্রীর মতো কথা বলেন না। মিডিয়ায় কথা বলার যদি সীমাবদ্ধতা থাকতো, তাহলে হয়তো ফরহাদ মজহার এমন কথা বলতেন না। যদি বলেও থাকেন তাহলে ক্ষমা চাইবেন তিনি। কিন্তু বক্তব্য বিকৃত করে তার বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠিকে লেলিয়ে দিয়ে তাকে হেয় করার চেষ্টার অভিযোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে কাদের সিদ্দিকী বলেন, সরকার কৌশলে সাংবাদিকদের বিভক্ত করছে। প্রধানমন্ত্রী জনসভায় বলেছেন, তিনি খুব অপমানিত বোধ করছেন। কিন্তু তিনি যখন আমাদের গরু-ছাগল বলেছেন তখন আমরা অপমানিত হইনি। যদি কেউ কাউকে অপমান করেন, তাহলে তিনি যেকোনোভাবেই অপমানিত হবেন। খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ১৫ আগস্টে কেউ জন্মগ্রহণ, মৃত্যু, বিয়েবার্ষিকী পালন করতেই পারে। শেখ মুজিবুরের জন্য কারো জন্মবার্ষিকী বন্ধ রাখা যায় না। বিরোধী দলীয় নেত্রী যদি তার ৬৯তম জন্মবার্ষিকীতে ৬৯টি গরু-ছাগল জবাই করে দাওয়াত দেন, তাহলে আমি ওই দাওয়াতে যাবো।
তথ্যমন্ত্রীর গ্রেফতার দাবি করে কাদের সিদ্দিকী বলেন, তথ্যমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার আগে অনেক সাংবাদিক নির্যাতন করেছেন। তথ্যমন্ত্রী না হয়ে তাকে সন্ত্রাসী হওয়া উচিত। ফোনালাপ প্রকাশ করে তথ্য আইন লঙ্ঘন করেছেন। এজন্য তাকে গ্রেফতার করা উচিত। তিনি বলেন, দিগন্ত টিভি, দিগন্ত পত্রিকায় লেখার দায়ে আমি মুক্তিযোদ্ধা থেকে রাজাকার হয়েছি। গণমাধ্যমের যারা কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে, তাদের বিচার হওয়া উচিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, মহীউদ্দীন খান আলমগীর মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি তো স্থায়ী রাজাকার। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করা হচ্ছে অস্থায়ী রাজাকারদের।
প্রফেসর ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, গণতান্ত্রিক কথা বললেই গণমাধ্যমের ওপর হামলা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার শুধু এখন নয়, সব সময় ক্ষমতায় এসে গণমাধ্যমের ওপর হামলা করেছে। দলটি অতীতেও ভিন্নমত সহ্য করতে পারেনি, এখনো পারছে না। সাংবাদিক সমাজ কখনো এক হতে পারবে না সরকারের কৌশলের কারণে। স্কাইপি সংলাপ প্রকাশের কারণে যদি মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়, তাহলে ফোনালাপ প্রকাশের দায়ে প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর গ্রেফতার দাবি জানান তিনি।
সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে ড. আসিফ নজরুল বলেন, কিছু গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমের নির্লজ্জ মালিকরা একটি দলের হয়ে মিথ্যাচার করছেন। এসব নির্লজ্জ মালিকদের কারণে আজ সাংবাদিক সমাজ দ্বিবিভক্ত। ফরহাদ মজহারের বিষয়ে তিনি অভিযোগ করেন, ফরহাদ মজহারের বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। তার সম্পূর্ণ বক্তব্য প্রকাশের দাবি জানান তিনি। এর আগে নির্লজ্জ এসব মিডিয়ায় অনেক উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়া হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রফেসর ড. পিয়াস করিম ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে জিডির নিন্দা জানিয়ে বলেন, ফরহাদ মজহার দেশ ও গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। একটি গোষ্ঠি একুশে টেলিভিশনে তার দেয়া বক্তব্য বিকৃত করেছে বলেও দাবি করেন তিনি। তার দাবি, ফরহাদ মজহারের ওপর হামলা হয়েছে আজ। যেসব আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী আজ ফরহাদ মজহারের গ্রেফতার দাবি করছেন, যদি আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় না আসে এবং ওই বুদ্ধিজীবীদের ওপর হামলা হয়, তাহলে আমরা প্রতিবাদ করবো। স্কাইপি সংলাপ প্রকাশের অভিযোগে যদি মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীর ফোনালাপ প্রকাশের দায়ে কেন প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীকে কেন গ্রেফতার করা হবে না বলে প্রশ্ন করেন তিনি। গণমাধ্যমে হামলা ও বন্ধের নিন্দা জানান পিয়াস করিম।
ড. তুহিন মালিক বলেন, ২৭ অক্টোবরের পর নির্বাচনকালীন সরকার নয়, নির্যাতনকালীন সরকার এসেছে। সরকার বলেছে, টকশো ও মিডিয়ার ৬০-৭০ জন ব্যক্তিকে ম্যানেজ করা যাচ্ছে না, যারা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। ফরহাদ মজহারকে দিয়ে হামলা শুরু, কার কাছে গিয়ে শেষ হয় তার জবাব চান তিনি।
সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, সরকার বাকশালী ভাইরাসে আক্রান্ত। ভিন্নমত প্রকাশ করলেই হয়রানি, ককটেল নিক্ষেপ, হামলা ভাঙচুর, হুমকি দেয়া হচ্ছে। ফরহাদ মজহারের বক্তব্য বিকৃতির অভিযোগ করে তিনি বলেন, সরকার তথ্য বিকৃত করে বুদ্ধিজীবীদের হেয় করেছে। তথ্য বিকৃতি, গণমাধ্যমের ওপর হামলা বন্ধের অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর গ্রেফতার দাবি করেন তিনি।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবদুস শহীদ বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় ক্ষমতায় এসে গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ করেছে। চ্যানেল ওয়ান থেকে শীর্ষ নিউজ বন্ধ করে দেয়াই এর প্রমাণ। সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেও সাগর-রুনি হত্যার বিচার পায়নি। সরকার সুকৌশলে সাংবাদিকদের মাঝে ফাটল ধরিয়ে সময় পার করেছে। ফোনালাপ প্রকাশ, তথ্য বিকৃতি, ফরহাদ মজহারের ওপর হামলার দায়ে প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর গ্রেফতার দাবি করেন তিনি।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াছ খান বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে সাগর-রুনিসহ ১৯ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। সাগর-রুনির বিচার নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাটক সাজিয়েছেন। সরকারি বাহিনী গণমাধ্যমের ওপর হামলা চালাচ্ছে আর সরকার গণমাধ্যম বন্ধ করছে। তিনি বন্ধ গণমাধ্যম খুলে দেয়া ও হামলার ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহবান জানান।
ডিইউজে’র সভাপতি আবদুল হাই শিকদারের পরিচালনা ও সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে সভায় বক্তব্য রাখেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সাংবাদিক শফিক রেহমান, কবি আল মাহমুদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আজাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সম্পাদক বাবুল আহমেদ, সাবেক সচিব আবদুল করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক প্রফেসর ইউসুফ হায়দার, ডা: জাফর উল্লাহ চোধুরী, প্রফেসর ড. মাহবুব উল্লাহ, বারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, বিচারপতি আব্দুর রউফ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, জেনারেল আয়িন উদ্দিন, আ ন হ আখতার হোসেন, চিত্রনায়ক বাবুল আহমেদ, চিত্রনায়ক আবুল কাশেম মিঠুন, আবুল আসাদ, বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, সাবেক সচিব সোলায়মান চোধুরী, আসিফা আশরাফি পাপিয়া এমপি, প্রফেসর ড. মুস্তাহিদুর রহমান, প্রেস কাব সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, সেক্রেটারি সৈয়দ আবদাল আহমদ, আজিজ আহমদ, মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম প্রমুখ।
তিনি বলেন, একটি বিতর্কিত টেলিভিশন মিডিয়া আমার বক্তব্য নিয়েছে। আমার বক্তব্যকে কাটছাট ও বিকৃত করে প্রচার করে আমাকে হেয় করার চেষ্টা করছে। সাংবাদিকদের বোমা মারার হুমকির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমি আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভিসহ বেশ কিছু মিডিয়ার সাথে যুক্ত ছিলাম। সেগুলো যখন বন্ধ হলো তখন চলুন আমরা সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা একসাথে হয়ে সব মিডিয়ার ওপর বোমা মারি। আমি যেহেতু মিডিয়া ও গণমাধ্যম কর্মী, আমি কখনো চাইবো না, মিডিয়ার ওপর বোমা হামলা। সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাকেও একইভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। মাহমুদুর রহমানের জামিন না দেয়ায় সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন তিনি।
জিডি ও সাংবাদিক নেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাকে যে গ্রেফতার ও মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয়েছে, তাতে আমি ভয় পাই না। মৃত্যুর ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। তথ্য বিকৃত করে হেয় করা আর হুমকি কোন ধরনের সাংবাদিকতা? তার বিরুদ্ধে অন্য অপপ্রচারেরও অভিযোগ তুলে এরও তীব্র নিন্দা জানান ফরহাদ মজহার। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মিজা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শুধু গণমাধ্যম নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্বই আজ আক্রান্ত। সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও কাজে কর্মে সম্পূর্ণ গণতন্ত্র বিরোধী। দেশের গণতন্ত্রকে কিভাবে ধ্বংস করা যায় তার সব কাজই করছে আওয়ামী লীগ সরকার। তারা পঁচাত্তরের মতো গত পাঁচ বছরে নানা ভয় দেখিয়ে সাংবাদিকদের হত্যা করে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বন্ধ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, বিনা অপরাধে মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে বন্দি করে রেখেছে। যে অপরাধে মাহমুদুর রহমানকে বন্দি রাখা হয়েছে একই অভিযোগে অভিযুক্ত বর্তমান তথ্যমন্ত্রী। তিনি অনুমতি না নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীর ফোনালাপ গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর এতে সায় ছিল। তাই প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত।
তিনি আরো বলেন, আমরা সংগ্রামে আছি। আমাদের মৌলিক অধিকার নির্বাচনকে দলীয় করছে সরকার। পাঁচ বছরে তারা জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে রসাতলে নিয়ে গেছেন। তাই সরকার নিজেদের অধীনে নির্বাচন দিয়ে আবার মতায় আসতে চায়।
ফরহাদ মজহার সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার অবাক লাগে, ফরহাদ মজহার এতো দেরিতে কেন আক্রান্ত হলেন। ফরহাদ মজহার একা নন, তার সাথে বিএনপিসহ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ রয়েছে। দেশের সচেতন মানুষ ফরহাদ মজহারের সাথে আছে। এই লড়াই বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা করার লড়াই। ১৯৭১-এ মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের আন্দোলনে অংশ নিয়ে এ লড়াই সংগ্রামে জয়লাভ করতে হবে।
সংবাদকর্মীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, যারা ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তারা সাগর-রুনিসহ প্রায় ১৭ জন সাংবাদিক হত্যার বিচার, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা টেলিভিশন বন্ধ, মাহমুদুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে তো কথা বলে না। তাই সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে দলমতের উর্ধ্বে থেকে কাজ করার আহবান জানান।
ড. আকবর আলী খান বলেন, দেশ আজ ক্রান্তিলগ্নে আছে। রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে গেছে। গত দুই দশক ধরে এদেশে রাজনৈতিক সংঘাত লেগেই আছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে এ সংঘাত নিরসন হবে না। বড় দুই জোটের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বড় দুই জোট নির্বাচনী ফর্মূলা নিয়ে বির্তক সৃষ্টি করছে। সংকটময় অবস্থা স্থায়ী হলে দেশ ও গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে। এ সংকটে দুই জোটকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের আহবান জানান তিনি। সিভিল সমাজের সমালোচনা করে তিনি বলেন, আজ সিভিল সমাজ রাজনীতির নামে দ্বিখণ্ডিত। এতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। ভেদাভেদ ভুলে নিবার্চন করার আহবান জানান তিনি।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, সংঘাত প্রধানমন্ত্রী সৃষ্টি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সরে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ফরহাদ মজহার সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীও তো প্রধানমন্ত্রীর মতো কথা বলেন না। মিডিয়ায় কথা বলার যদি সীমাবদ্ধতা থাকতো, তাহলে হয়তো ফরহাদ মজহার এমন কথা বলতেন না। যদি বলেও থাকেন তাহলে ক্ষমা চাইবেন তিনি। কিন্তু বক্তব্য বিকৃত করে তার বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠিকে লেলিয়ে দিয়ে তাকে হেয় করার চেষ্টার অভিযোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে কাদের সিদ্দিকী বলেন, সরকার কৌশলে সাংবাদিকদের বিভক্ত করছে। প্রধানমন্ত্রী জনসভায় বলেছেন, তিনি খুব অপমানিত বোধ করছেন। কিন্তু তিনি যখন আমাদের গরু-ছাগল বলেছেন তখন আমরা অপমানিত হইনি। যদি কেউ কাউকে অপমান করেন, তাহলে তিনি যেকোনোভাবেই অপমানিত হবেন। খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ১৫ আগস্টে কেউ জন্মগ্রহণ, মৃত্যু, বিয়েবার্ষিকী পালন করতেই পারে। শেখ মুজিবুরের জন্য কারো জন্মবার্ষিকী বন্ধ রাখা যায় না। বিরোধী দলীয় নেত্রী যদি তার ৬৯তম জন্মবার্ষিকীতে ৬৯টি গরু-ছাগল জবাই করে দাওয়াত দেন, তাহলে আমি ওই দাওয়াতে যাবো।
তথ্যমন্ত্রীর গ্রেফতার দাবি করে কাদের সিদ্দিকী বলেন, তথ্যমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার আগে অনেক সাংবাদিক নির্যাতন করেছেন। তথ্যমন্ত্রী না হয়ে তাকে সন্ত্রাসী হওয়া উচিত। ফোনালাপ প্রকাশ করে তথ্য আইন লঙ্ঘন করেছেন। এজন্য তাকে গ্রেফতার করা উচিত। তিনি বলেন, দিগন্ত টিভি, দিগন্ত পত্রিকায় লেখার দায়ে আমি মুক্তিযোদ্ধা থেকে রাজাকার হয়েছি। গণমাধ্যমের যারা কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে, তাদের বিচার হওয়া উচিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, মহীউদ্দীন খান আলমগীর মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি তো স্থায়ী রাজাকার। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করা হচ্ছে অস্থায়ী রাজাকারদের।
প্রফেসর ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, গণতান্ত্রিক কথা বললেই গণমাধ্যমের ওপর হামলা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার শুধু এখন নয়, সব সময় ক্ষমতায় এসে গণমাধ্যমের ওপর হামলা করেছে। দলটি অতীতেও ভিন্নমত সহ্য করতে পারেনি, এখনো পারছে না। সাংবাদিক সমাজ কখনো এক হতে পারবে না সরকারের কৌশলের কারণে। স্কাইপি সংলাপ প্রকাশের কারণে যদি মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়, তাহলে ফোনালাপ প্রকাশের দায়ে প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর গ্রেফতার দাবি জানান তিনি।
সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে ড. আসিফ নজরুল বলেন, কিছু গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমের নির্লজ্জ মালিকরা একটি দলের হয়ে মিথ্যাচার করছেন। এসব নির্লজ্জ মালিকদের কারণে আজ সাংবাদিক সমাজ দ্বিবিভক্ত। ফরহাদ মজহারের বিষয়ে তিনি অভিযোগ করেন, ফরহাদ মজহারের বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। তার সম্পূর্ণ বক্তব্য প্রকাশের দাবি জানান তিনি। এর আগে নির্লজ্জ এসব মিডিয়ায় অনেক উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়া হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রফেসর ড. পিয়াস করিম ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে জিডির নিন্দা জানিয়ে বলেন, ফরহাদ মজহার দেশ ও গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। একটি গোষ্ঠি একুশে টেলিভিশনে তার দেয়া বক্তব্য বিকৃত করেছে বলেও দাবি করেন তিনি। তার দাবি, ফরহাদ মজহারের ওপর হামলা হয়েছে আজ। যেসব আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী আজ ফরহাদ মজহারের গ্রেফতার দাবি করছেন, যদি আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় না আসে এবং ওই বুদ্ধিজীবীদের ওপর হামলা হয়, তাহলে আমরা প্রতিবাদ করবো। স্কাইপি সংলাপ প্রকাশের অভিযোগে যদি মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীর ফোনালাপ প্রকাশের দায়ে কেন প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীকে কেন গ্রেফতার করা হবে না বলে প্রশ্ন করেন তিনি। গণমাধ্যমে হামলা ও বন্ধের নিন্দা জানান পিয়াস করিম।
ড. তুহিন মালিক বলেন, ২৭ অক্টোবরের পর নির্বাচনকালীন সরকার নয়, নির্যাতনকালীন সরকার এসেছে। সরকার বলেছে, টকশো ও মিডিয়ার ৬০-৭০ জন ব্যক্তিকে ম্যানেজ করা যাচ্ছে না, যারা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। ফরহাদ মজহারকে দিয়ে হামলা শুরু, কার কাছে গিয়ে শেষ হয় তার জবাব চান তিনি।
সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, সরকার বাকশালী ভাইরাসে আক্রান্ত। ভিন্নমত প্রকাশ করলেই হয়রানি, ককটেল নিক্ষেপ, হামলা ভাঙচুর, হুমকি দেয়া হচ্ছে। ফরহাদ মজহারের বক্তব্য বিকৃতির অভিযোগ করে তিনি বলেন, সরকার তথ্য বিকৃত করে বুদ্ধিজীবীদের হেয় করেছে। তথ্য বিকৃতি, গণমাধ্যমের ওপর হামলা বন্ধের অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর গ্রেফতার দাবি করেন তিনি।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবদুস শহীদ বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় ক্ষমতায় এসে গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ করেছে। চ্যানেল ওয়ান থেকে শীর্ষ নিউজ বন্ধ করে দেয়াই এর প্রমাণ। সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেও সাগর-রুনি হত্যার বিচার পায়নি। সরকার সুকৌশলে সাংবাদিকদের মাঝে ফাটল ধরিয়ে সময় পার করেছে। ফোনালাপ প্রকাশ, তথ্য বিকৃতি, ফরহাদ মজহারের ওপর হামলার দায়ে প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর গ্রেফতার দাবি করেন তিনি।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াছ খান বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে সাগর-রুনিসহ ১৯ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। সাগর-রুনির বিচার নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাটক সাজিয়েছেন। সরকারি বাহিনী গণমাধ্যমের ওপর হামলা চালাচ্ছে আর সরকার গণমাধ্যম বন্ধ করছে। তিনি বন্ধ গণমাধ্যম খুলে দেয়া ও হামলার ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহবান জানান।
ডিইউজে’র সভাপতি আবদুল হাই শিকদারের পরিচালনা ও সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে সভায় বক্তব্য রাখেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সাংবাদিক শফিক রেহমান, কবি আল মাহমুদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আজাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সম্পাদক বাবুল আহমেদ, সাবেক সচিব আবদুল করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক প্রফেসর ইউসুফ হায়দার, ডা: জাফর উল্লাহ চোধুরী, প্রফেসর ড. মাহবুব উল্লাহ, বারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, বিচারপতি আব্দুর রউফ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, জেনারেল আয়িন উদ্দিন, আ ন হ আখতার হোসেন, চিত্রনায়ক বাবুল আহমেদ, চিত্রনায়ক আবুল কাশেম মিঠুন, আবুল আসাদ, বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, সাবেক সচিব সোলায়মান চোধুরী, আসিফা আশরাফি পাপিয়া এমপি, প্রফেসর ড. মুস্তাহিদুর রহমান, প্রেস কাব সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, সেক্রেটারি সৈয়দ আবদাল আহমদ, আজিজ আহমদ, মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম প্রমুখ।