হংকংয়ের অন্ধকার জগতে বাংলাদেশীদের নরক যন্ত্রণা
মোহাম্মদ আবুল হোসেন: হংকং আধুনিককালে উন্নতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেও সেখানে রয়েছে এক অন্ধকার জগৎ। সেই জগতের বাসিন্দা আর কেউ নন, বাংলাদেশীরা। অবৈধভাবে অথবা আশ্রয় প্রার্থনা করে যারা হংকং পাড়ি জমিয়েছেন তাদেরকে সেখানে বাস করতে হচ্ছে এক ‘জীবন্ত নরকে’। তাদেরকে কোন কাজ দেয়া হয় না। বসবাস করেন একেবারে জীর্ণ কুটিরে। দেয়া হয় স্বল্প খাবার। চিকিৎসা সেবা নেই বললেই চলে। সেখানে এমন জীবন যাপন করছেন বাংলাদেশের বেশ ক’জন মানুষ- মজিবুর (৪২), সাইদুর রহমান, সেলিম (৪৩), জহির, আরিফ (২৬), হাশেম, দেলোয়ার প্রমুখ। চীনের মূল সীমান্তের কাছে হংকংয়ের নিউ টেরিটরির ছোট গ্রাম পিং চি। সেখানেই আটক রাখা হয়েছে তাদের। শুধু তারাই নয়। অন্য দেশেরও অভিবাসীরা রয়েছেন সেখানে। এর মধ্যে দীর্ঘ চুলবিশিষ্ট আরিফ বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়েছেন আশ্রয়ের সন্ধানে। তাকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছে তা একরকম এক ধ্বংসস্তূপ। ক্ষয়ে গেছে বিম এমন কয়েকটি ধাতব শিটের ওপর কোনমতে তৈরি করা একটি ঘর। তার মাঝে বয়ে চলেছে পানি। অপরিচ্ছন্ন টয়লেটের কাছে মাছি ভনভন করছে। টয়লেট বলতে রান্নার স্থানে একটি গর্ত। সেখানেই তাকে সারতে হয় প্রাকৃতিক কাজ। যে পানি তাকে দেয়া হয় তা অপরিচ্ছন্ন। বিদ্যুৎ আসে আর যায়। এক রাতে যখন আরিফ ঘুমিয়ে ছিলেন অকস্মাৎ ছাদের একটি অংশ ভেঙে পড়ে তার মাথায়। আরিফের দাবি, আমি একটু ভাল স্থানে বাস করতে চাই। নিজের দেশে নির্যাতন অথবা বিচার থেকে বাঁচার জন্য আরিফের মতো বছরে শ’ শ’ মানুষ হংকংয়ে পাড়ি জমায়। তারা ভাবে সেখানে যেতে পারলেই রক্ষা। কিন্তু হংকংয়ে পৌঁছামাত্র শুরু হয় কষ্টের আরেক অধ্যায়। তারা যখন সেখানে পৌঁছে কাগজপত্র প্রক্রিয়াজাত করতে দেয় তা প্রক্রিয়াজাত হতে বছরের পর বছর লেগে যায়। আবার কখনও আশ্রয়ের আবেদন নাকচ হয়ে যায়। যারা এভাবে আশ্রয়প্রার্থী হন তাদেরকে কোন কাজ করতে দেয়া হয় না। জোর করে আটকে রাখা হয় ওই রকম নিম্নমানের বাসস্থানে। বেঁচে থাকা যায় শুধু এতটুকুই খাবার দেয়া হয়। কিছু মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীর মতে, এটা করা হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে। হংকংয়ের শরণার্থী সহায়তা বিষয়ক সংস্থা ভিশন ফার্স্ট-এর পরিচালক কসমো বিটসন বলেন, শরণার্থীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয় তা মানবিক নয়। আরিফ বলেছেন, আমাদের অনেকেই এখানে এসেছেন তাদের জীবন বাঁচাতে। কিন্তু এখন দেখছি এর চেয়ে মরে যাওয়াও ভাল। এমনভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। আমরা যেভাবে বেঁচে আছি একে জীবন বলে না। আরিফের মূল বাড়ি খুলনায়। তিনি ফার্মাকোলজির ছাত্র ছিলেন। কসমো বিটসন বলেন, আরিফ আসলেই একটি স্মার্ট ছেলে। এখন থেকে চার বছর আগে খুলনার এই ছেলেটি ভাল একটি সাবজেক্টে পড়াশোনা করছিল। কিন্তু তার সফলতা নজরে পড়ে সন্ত্রাসীদের। তারা তার গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তাকে মারধর করে। তাকে হত্যার হুমকি দেয়। তারা তার কাছে প্রাণরক্ষা বাবদ বিপুল অঙ্কের অর্থ চায়। এ অবস্থায় তিনি জীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। একজন এজেন্টের সহায়তা চান। ওই এজেন্ট তাকে আয়ারল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তাকে স্বপ্ন দেখায়। এ প্রতারণার মাধ্যমে এজেন্ট তার সব সহায় সম্বল নিয়ে নেয়। তাকে ফেলে যায় হংকং। আরিফ বলেন, আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। যখন জানতে পারলাম আমি হংকংয়ে, হতাশায় তখন মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ১৯৭০-এর দশকে যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধের শরণার্থীদের ঢল নেমেছিল তখন যে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে রক্ষা পেতে হংকং সরকার আগেভাগেই ব্যবস্থা নিয়েছে। তারা শরণার্থীদের অনুৎসাহিত করছে। যদি কোন শরণার্থীকে অবৈধভাবে সেখানে কাজ করতে দেখা যায় তাহলে তাকে ২২ মাসের জেল দেয়া হয়। আর যদি নিজেই ধরা দেয় আরিফের মতো তাহলে তাকে নেয়া হয় ‘নরক’ সদৃশ কারাগারে। যেখানে কোন আর্থিক লাভ নেই। এ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে সমাজকল্যাণ বিষয়ক ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিস (আইএসএস)। প্রতি মাসে আইএসএস আরিফকে ১২০০ হংকং ডলার ভাড়া বাবদ বৃত্তি দিয়ে থাকে। তাতে তার বাসা ভাড়া হয় কোনমতে। এ থেকে কোন অর্থ জমা করা যায় না। অন্য শরণার্থীদের মতো তিনি খাদ্য বাবদ পান ৯০০ ডলার। আরেক বাংলাদেশী শরণার্থী সেলিম (৪৩)। তিনি বাস করেন আরিফের সঙ্গে। এখন থেকে ৯ বছর আগে সন্ত্রাসীরা তার খুচরা ব্যবসার সব কিছু কেড়ে নেয়। পরিবারকে হত্যার হুমকি দেয়। এ অবস্থায় তিনি পালিয়ে যান হংকং। তিনি বলেন, জীবন বাঁচাতে আমাদের অনেকে এখানে পালিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখন দেখি এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল ছিল। আবর্জনায় ভরা তার ছোট্ট রুম। তার ভিতর রয়েছে পুরনো জিনিসপত্র, রান্নার জিনিসপত্র, আসবাবপত্র ইত্যাদি। তিনি বলেন আইএসএস তাদেরকে অর্থ দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। তারা সে অর্থে ঠিকমতো চিকিৎসা নিতে পারেন না। আরেক বাংলাদেশী শরণার্থী মজিবর (৪২)। তিনি এখন চার মাস বয়সী এক সন্তানের পিতা। সাইদুর রহমান যেখানে বাস করেন সেখানে ঘরের মধ্যেই সব। নেই উপযুক্ত পানীয়র ব্যবস্থা। তাই হোস পাইপ লাগিয়ে তাতে মুখ লাগিয়ে তিনি পানি পান করেন। একই রকম অবস্থা সেলিম, জহির, হাশেমের। তাদের অবস্থা দেখে ভিশন ফার্স্ট-এর নির্বাহী পরিচালক কসমো বিটসন পরামর্শের জন্য তাদের কাছে এগিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, শরণার্থীরা যেভাবে বেঁচে আছেন তা দেখে মর্মাহত হতে হয়। ভিশন ফার্স্টের মতে, গত ২১ বছরে হংকংয়ে ১২০০০ মানুষ আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন, নির্যাতনকে কারণ দেখিয়ে। কসমো বিটসন বলেছেন, এটা একটি সুড়ঙ্গের মতো, যার শেষ প্রান্তে কোন আলোর দেখা নেই। যারা স্বর্গের সুখের আশায় হংকং যাচ্ছেন তারা আসলে মরীচীকার পিছনে দৌড়াচ্ছেন।