আড়িপাতা বন্ধ করছে যুক্তরাষ্ট্র ?
বরকতুল্লাহ সুজন : ফোন ও ইন্টারনেটে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাবৃত্তির বিরুদ্ধে বলা চলে এখন গোটা বিশ্বই সোচ্চার, আতঙ্কিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। এশিয়ায় এদের অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র বলে পরিচিত। তবে মার্কিন কর্মসূচির বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদী বিবৃতির ভাষায় ছিলো ক্রোধ আর গভীর উদ্বেগ। ঐ বিবৃতিতে তারা গোপন গোয়েন্দা কর্মসূচির ব্যাপারে ওয়াশিংটনের কাছে পরিষ্কার ব্যাখ্যা চেয়েছে। এর আগে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ লাতিন ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো ওয়াশিংটনের গোয়েন্দা নজরদারির তীব্র সমালোচনা করে। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) সার্ভার হ্যাকিংয়ের বিরুদ্ধে নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে খোদ আমেরিকারই ইন্টারনেট সেবা প্রতিষ্ঠান গুগল, অ্যাপল ও ইয়াহু। দেশি-বিদেশি এত সব চাপের মুখে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায় হোয়াইট হাউস, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট, এনএসএ। কিন্তু কুটনীতির ভাষায় দেয়া এসব জবাবে কি সন্তুষ্ট সংক্ষুব্ধ দেশগুলো! আর চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্র কি তার বিতর্কিত এই কর্মসূচি বন্ধ করবে?
গত শুক্রবার এসব ইস্যুতে প্রথমবারের মতো মুখ খোলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। তবে সম্ভবত তাঁর কথায় সন্তুষ্ট হয়নি কেউই। কারণ জন কেরি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরকে পুরোপুরি উড়িয়ে না দিয়ে বরং তা স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি জানান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোয়েন্দাবৃত্তির কাজকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। তবে এ ধরনের কাজ আর যাতে না ঘটে সেজন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে শিগগিরই কাজ শুরু করবেন বলে জানান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ইতিমধ্যে বারাক ওবামা মিত্র দেশগুলোর উপর গুপ্তচরবৃত্তি বন্ধ করতে এনএসএ-কে নির্দেশ দিয়েছেন বলে মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর এ আশ্বাসবাণী সত্ত্বেও জার্মান সরকার চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মসূচি সম্পর্কে রাশিয়ায় পলাতক সাবেক এনএসএ গোয়েন্দা কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেনের কাছ থেকে সরাসরি তথ্য জানতে, যিনি ওয়াশিংটনের এই অতিগোপন কর্মসূচি ফাঁস করে দিয়ে উইকিলিক্সের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মতোই আলোচিত হন। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার মস্কোতে ঝটিকা সফরে গিয়ে স্নোডেনের সাথে দেখা করেছেন জার্মান পার্লামেন্ট সদস্য হ্যানস-ক্রিস্টিয়ান স্টোয়েবেলে। শুক্রবার বার্লিনে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি জানান, এনএসএর গুপ্তচরবৃত্তির ব্যাপারে জার্মান সরকারকে ব্রিফ করতে রাজি হয়েছেন স্নোডেন। এ ব্যাপারে তার একটি চিঠির কপিও দেখান তিনি।
মিত্র হওয়া সত্ত্বেও জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের সেলফোনে আড়ি পাতায় সবচেয়ে ক্ষুব্ধ দেশটি। বিষয়টি বার্লিন কতটা গুরুত্ব দিয়ে তারা দেখছে, তা বোঝাতে মার্কেল তার শীর্ষ দুই উপদেষ্টাকে পাঠিয়েছেন ওয়াশিংটনে। তারা হলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ক্রিস্টোফ হিউসজেন এবং গোয়েন্দা সমন্বয়ক গুয়েন্টার হুয়েস। জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা নজরদারির পরিধি জানা এবং এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বেগ জানানো তাদের এ সফরের লক্ষ্য। এছাড়াও চলতি সপ্তাহে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানদের সাথে সরাসরি দেখা করতে জার্মানির শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্র যাবার কথা রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খেয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর ক্ষুব্ধ প্রতিবাদে। কারণ ওবামা প্রশাসনের পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি অনুসারে এ অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক-বাণিজ্যিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বিস্তৃত করতে যুক্তরাষ্ট্র এখন সবচেয়ে বেশি মনোযোগী।
মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা বা বিশ্বের অন্য যে কোন স্থানের চেয়ে ওয়াশিংটনের কাছে এখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা কর্মসূচির বিরুদ্ধে চীনের পাশাপাশি একযোগে ক্ষোভ আর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। তবে সবচেয়ে কঠোর ভাষা ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়া। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্টি নাতালিগাওয়া বন্ধু দেশে এমন কর্মসূচিকে কূটনৈতিক নিষ্ঠাচার ও নিয়ম-নীতির গুরুতর লঙ্ঘন বলে সমালোচনা করেন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর এমন ক্ষোভের কারণ অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানির দু’টি পত্রিকার প্রতিবেদন। এ অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ খবরটি প্রকাশ করে সিডনি মর্নিং হেরাল্ড ও দার স্পাইজেল ম্যাগাজিন। ঐ দু’টি পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রিজম’ গোয়েন্দা কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের একার নয়। বরং এর সাথে যুক্ত অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড। তাদের এই গোয়েন্দা সহযোগিতা চুক্তির নাম ‘ফাইভ আইজ’। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড জানায়, দক্ষিণ-পূর্ণ এশিয়ার রাজধানীগুলোতে ফোনে আড়ি পাতাসহ অন্যান্য গোয়েন্দা তথ্য সহযোগিতার জন্য অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাসকে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হচ্ছে, বিশ্বের প্রায় আশিটি দূতাবাস ও কনস্যুলেট কার্যালয় থেকে আধুনিক প্রযুক্তি ও ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে গোপনে ব্যাপকভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
দূতাবাসের ঐ নির্দিষ্ট কক্ষের কোড নেইম বা সাংকেতিক নাম ‘স্টেটরুম’। ইউরোপে এমন ঊনিশটি দূতাবাসে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় স্টেটরুম স্থাপন করা হয়েছে। এশিয়ার কোন্ কোন্ নগরী থেকে যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে, তারও একটা তালিকা প্রকাশ করেছে পত্রিকা দু’টি। এগুলো হলো- জাকার্তা, ব্যাংকক, হ্যানয়, বেইজিং, পূর্ব তিমুরের দিলি, কুয়ালালামপুর এবং পাপুয়া নিউগিনির মোর্সবি। এসব নগরীতে অবস্থিত বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাস মার্কিন গোয়েন্দা কর্মসূচিতে ব্যবহূত হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। এর প্রতিবাদে অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এর কড়া সমালোচনা করে জাকার্তা।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, শুরুতে ‘মেটাডাটা’ আকারে টেক্সট, অডিও এবং ভিডিও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর ঐসব তথ্যকে এনএসএর নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের ছাঁচে ফেলা হয়, যাকে বলে ‘মাসকুলার’। ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এমনকি জাতিসংঘে নিযুক্ত দূতদের কথাবার্তাও এভাবে রেকর্ড করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এ ব্যাপারে মুখ খুলছেন না দেশটির কোন কর্তাব্যক্তি। আন্তর্জাতিক চাপ ও নানামুখী প্রশ্ন ওঠা সত্ত্বেও তাই জানা যাচ্ছে না বিতর্কিত ‘প্রিজম’ কর্মসূচি আদৌ বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত হবে কি-না। এরই মধ্যে ওয়াশিংটনের গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট অনেকেই এই গোয়েন্দাবৃত্তির পক্ষে বলতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন, যে কোন দেশেরই গোয়েন্দা সক্ষমতা অর্জন ঐতিহাসিক অধিকার। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, সব শক্তিধর দেশেরই গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ছিলো শক্তিশালী। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইতিহাসে জুলিয়াস সিজারের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ছিলো সবচেয়ে শক্তিশালী। কাউকেই বিশ্বাস না করার প্রবণতা ছিলো তাঁর। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিলো জুলিয়াস সিজারের।