অস্তিত্ব সংকটে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রায় সব দেশেই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করতে চাইলেও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে তা চাইতে দেখা যায় না। বরং সংখ্যালঘু সমাজকে কোণঠাসা করে রাখতেই তাদের তৎপর দেখা যায় বেশি। তেমন ঘটনাই ঘটছে মিয়ানমারে। বৈষম্যে ও অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে দেশটির রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়।
বর্মী আইনে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নন। নাগরিক অধিকার তাদের প্রাপ্য নয়। দেশের ভেতরে ভ্রমণ করার জন্য প্রশাসনের অনুমতি চাইতে হয় রোহিঙ্গাদের।
জাতিগত রাখাইনদের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরোধ ও উত্তেজনা গত দু’বছরে ক্রমে বেড়েছে। ক্রমে দুর্ভর হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জীবনযাত্রা। চলতি সহিংসতা শুরুর পূর্ব পর্যন্ত আইনি ও জাতিগত ক্ষেত্রেই সীমায়িত ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা। ইদানীং সমস্যাটি গড়িয়েছে ধর্মীয় পরিসরে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধ মোহান্তেরা ও মুসলিম গোষ্ঠীগুলো আজকাল পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ঊভয় পক্ষ ইন্ধন পাচ্ছে বাইরে থেকে।
বৌদ্ধ সাধুরা ও রাখাইনরা প্রকাশ্যে প্রচার চালাচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া না দেয়া হচ্ছে সরকারের এখতিয়ার। এ প্রশ্নে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। অন্যদিকে এরাই সরকারকে চাপে রেখেছে এই বলে যে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া যাবে না। কারণ রোহিঙ্গারা হচ্ছে বেআইনি বাঙালি অভিবাসী। রোহিঙ্গাদের দাবি, তারা আরাকান রাজ্যের বাসিন্দা কয়েকশ’ বছর ধরে। ইতিহাসসম্মত তথ্য ও সাক্ষ্য প্রতিটি মঞ্চে পেশ করে রোহিঙ্গারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, রাজ্যের ও বার্মার ভূমিপুত্র হিসেবে তারা আরাকানে বসবাস করছেন।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, প্রায় অর্ধশত বছর সামরিক একনায়কের শাসনে থাকার দরুন চলমান সংকট মোকাবিলার সামর্থ্য মিয়ানমার হারিয়ে বসেছে। মিলিটারি ডিক্টেটরের পলিসির কারণে নানা সমস্যায় ভুগছে আজ পুরো দেশ। সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়েছে জাতিগত সংখ্যালঘু লোকগুলোর অবস্থা।
তাদের মতে, কেবল রোহিঙ্গা সম্প্রদায় নয়, দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের নিবন্ধিত করানোর ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রক্রিয়াগত বাধাসহ বহুতর বৈষম্য সংকটে ভুগতে বাধ্য করা হচ্ছে খৃস্টান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের কাচিন, শাম, চীন ও ইন্ডিয়ানদেরও।
বহু চিন্তাবিদের বক্তব্য হচ্ছে, সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যকার শত্রুতার শেকড় বার্মার রাষ্ট্রীয় জীবনের অনেক গভীরে প্রবেশ করে বসেছে।
চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, আরাকানে রোহিঙ্গাদের সহিংস উচ্ছেদে তৎপর রাখাইন বৌদ্ধদেরও প্রচ- ক্ষোভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে বর্মী সংখ্যাগুরুদের বিরুদ্ধে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বর্মী প্রশাসনের মনোভাব সে তুলনায় অনেক বেশি বৈরী। রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব পাচ্ছেন না। আরাকানের নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকার বাইরে তাদের যাওয়া-আসার অধিকার নেই। শেষ এখানেই নয়। সংসদ অধিবেশনে শরীক হতে ইয়াঙ্গুন যাওয়ার জন্য স্থানীয় থানার অনুমতি নেয়া রোহিঙ্গা সংসদ সদস্যের জন্য বাধ্যতামূলক।
কট্টরপন্থী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও রাখাইন নেতাদের সঙ্গে বার্তালাপ শেষে আন্তর্জাতিক ভাষ্যকারদের অভিমত হচ্ছে, রোহিঙ্গারা শুধু জাতিগত ও ধর্মীয় বাধা-বৈষম্যেই ভুগছেন না, সামাজিক বৈষম্যে ভুগতেও তাদের বাধ্য করা হচ্ছে।
রাখাইনদের অভিযোগ হচ্ছে, মুসলমানরা প্রকাশ্যে পশু জবেহ করে থাকেন, কয়েকজনকে বিয়ে করেন ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশেন না। স্থানীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক উৎসবে শামিল না হওয়া তাদের অভিযোগ ও অসন্তোষ রয়েছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে।
মিয়ানমারে সক্রিয় দশটি মুসলিম সংগঠনের মধ্যে ৫টি হচ্ছে সরকারিভাবে নথিভুক্ত। মজার বিষয় হচ্ছে মুসলিম সংগঠনগুলো উপ-সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক ভিত্তিতে বিভক্ত। এদের সদস্যদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছেন ইন্ডিয়ান ও চীনা (পান্থায়া) মুসলিম। ধর্মীয় অভিন্নতার তাগিদেও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশতে তারা অনিচ্ছুক।
রাজনৈতিক ও সম্প্রদায়গত স্বার্থে রোহিঙ্গা নেতৃত্ব সুসংগঠিত হলেও তারা মুশকিলে পড়েছেন দুটো বড় সমস্যার কারণে। একটি আসছে বার্মার অন্যান্য মুসলমানদের পক্ষ থেকে এবং অন্যটি জন্ম দিচ্ছে বাংলাদেশের কক্সবাজারে ও করাচির কোরাঙ্গিতে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা উগ্র গোষ্ঠীগুলো।
এরা আরাকানে ঢোকার চেষ্টাও চালাচ্ছে। আরাকানের রোহিঙ্গারা কক্সবাজার ও করাচির উগ্রপন্থীদের ভালো চোখে দেখেন না। কিন্তু আরাকানী রোহিঙ্গাদের জঙ্গী বিরোধী মনোভাবের সমাদর করেন না অন্য বর্মীরা ও বৌদ্ধরা। রোহিঙ্গাদের সম্বন্ধে একটি মাত্র ধারণাতেই তারা অটল যে, রোহিঙ্গারা আজ নাগরিকত্বের দাবি জানাচ্ছে পরবর্তীতে মিয়ানমারে নিজেদের জন্য পৃথক একটি রাজ্য গড়ার লক্ষ্যে।
অন্য ভয়ঙ্কর সমস্যাটি জন্ম দিয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ‘ইউএনএস সিআর-এর মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ২ লাখের বেশি। এদের মধ্যে ৩০ হাজারের কিছু বেশি হচ্ছে নিবন্ধিত। বার্মা সীমান্ত থেকে মাত্র ২ কি.মি. দূরত্বে দুটি সরকারি ক্যাম্পে এরা আশ্রিত। শরণার্থীদের অবৈধ অভিবাসী মনে করে বাংলাদেশ সরকারও। শরণার্থীদের চলাফেরায় বিধিনিষেধ রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান খুব সহজ কোনো কাজ নয়। বড় পরিসরে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় রূপান্তর প্রক্রিয়া বর্তমানে মিয়ানমারে জারি দেখা যাচ্ছে। বর্মী সরকার এবং রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোকে এই রূপান্তর প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছন্দ করে তোলার জন্য পরস্পরের কাছাকাছি এগিয়ে আসার তাগিদ অনুভব করতে হবে। রোহিঙ্গা নাগরিকত্ব প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টির কাজ এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। অন্যসব সম্প্রদায়কে এড়িয়ে চলার অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রোহিঙ্গাদেরও আগ্রহী ও তৎপর হতে হবে। সমাধানে সংখ্যাগুরু পক্ষের ওপর দায়িত্ব বর্তায় সবচেয়ে বেশি। সে গুরুদায়িত্ব পালনে মিয়ানমারের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসবেন-এটিই প্রত্যাশিত। [ডন]