অরক্ষিত সিলেট সীমান্ত ‘অতন্দ্র প্রহরী’র ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

Borderআবদুল মুকিত : আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ সীমানায় উড়ছে ভারতীয় হেলিকপ্টার। সীমান্ত ব্যারিকেড ডিঙ্গিয়ে ঢুকছে গাড়ি। বানের মতো আসছে অস্ত্র, গোলাবারুদ আর মাদকের চালান। বিনাবাধায় ভারতীয়রা ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি মানুষ আর গবাদিপশু। তাদের গুলিতে পাখির মতো মরছে মানুষ। লাশ মিলছে সীমান্তের ওপারে লোকালয়-জঙ্গলে। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সিলেট সীমান্তজুড়ে। কিন্তু সীমান্ত রক্ষা বা প্রহরার দায়িত্ব যাদের ওপর সেই বিজিবি জওয়ানরা কি করছে? এমন প্রশ্নের জবাব মিলছে না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এসব ঘটনার পর প্রতিবাদ পাঠানো আর পতাকা বৈঠক ডেকেই দায়িত্ব পালন ছাড়া যেন আর কোনো কর্ম নেই তাদের। ফলে সবসময়ই উদ্বেগ আর আতঙ্কে কাটছে সীমান্ত জনপদবাসীর দিনকাল। সেই সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয়টিও মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। সচেতন মহলের মতে, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিজিবি জওয়ানদের সীমান্ত প্রহরার পরিবর্তে রাজপথের সংঘাত মোকাবেলায় নামানোর কারণেই কার্যত অরক্ষিত হয়ে পড়েছে সীমান্ত। আর সীমান্ত অরক্ষিত হলে যা হতে পারে-তাই-ই হচ্ছে। এর আংশিক নমুনাও দেখা যাচ্ছে ইদানিং। এ সুযোগটি নিচ্ছে, পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে বিএসএফ, ভারতীয় খাসিয়া এবং আন্তঃদেশীয় চোরাকারবারীসহ অপরাধীরা।
সিলেটের সীমান্তজুড়ে ভারতীয়দের আগ্রাসী কর্মকান্ড নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ই ভারতীয়রা বাংলাদেশ ভূখন্ডে অবৈধ অনুপ্রবেশ করছে। বাংলাদেশি সীমান্ত জনপদবাসীর চাষাবাদে বাধা দেয়া, বাংলাদেশ ভূখন্ড থেকে মাছ, গবাদিপশু ধরে নিয়ে যাওয়া, কারণে-অকারণে গুলি ছোঁড়া সীমান্তে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। সেই সঙ্গে রয়েছে অপ্রতিরোধ্য সীমান্ত চোরাচালানের বিষয়টিও। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে সাম্প্রতিকালের দু’টি ঘটনা সীমান্ত প্রহরীদের দায়িত্বপালনের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর একটি হচ্ছে সীমান্ত প্রহরীদের সামনে দিয়ে প্রকাশ্যে দু’টি জিপ বাংলাদেশে ঢুকে পড়া এবং অপরটি হচ্ছে আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ ভূখন্ডের লোকালয়ের ওপর ভারতীয় হেলিকপ্টারের অবস্থান বা চক্কর দেয়া। গত বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ ভূখন্ডের প্রায় ৪ কিলোমিটার অভ্যন্তরে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার লালখাল এলাকায় ঢুকে পড়ে ভারতীয় পতাকাবাহী একটি হেলিকপ্টার।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, ওই হেলিকপ্টারটি লালাখাল হয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা সদরের রাজবাড়ি খেলার মাঠের ওপর কয়েকবার চক্কর দিয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলার সোনারহাট সীমান্ত এলাকায় আরও তিন বার চক্কর দিয়ে আবারও ডাউকি সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে চলে যায়। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন স্থানীয় বিজিবি কর্মকর্তারাও। এ ঘটনার পর বিজিবি’র পক্ষ থেকে হেলিকপ্টার অনুপ্রবেশের বিষয়ে ভারতীয় ১০৮ বিএসএফ-এর কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা। তবে ঘটনার চারদিন পর গতকাল রোববার বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এর কোনো ব্যাখ্যা পায়নি বিজিবি।
এর পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে বিয়ানীবাজারের সুতারকান্দি শুল্কস্টেশন দিয়ে ভারত থেকে আসা দু’টি মিটসুবিসি জিপ অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে। কাস্টম ও ইমিগ্রেশনের লোকজনের পাশাপাশি বিজিবি জওয়ানদের চোখের সামনেই এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার প্রায় আধাঘণ্টা পর টনক নড়ে বিজিবি ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের। অনুপ্রবেশকারী গাড়ি দু’টি আটকাতে সিলেটের বিভিন্ন সড়কে বসানো হয় প্রায় ১৬টি চেকপোস্ট। কিন্তু সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বিনাবাধায় প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে রহস্যজনকভাবে গাড়ি দু’টি দিনদুপুরে পৌঁছায় সিলেট নগরীতে! বিভিন্ন সূত্রের দেয়া তথ্যে জানা যায়, গাড়ি দু’টি বৃহস্পতিবার বেলা ২টা থেকে ৩টার মধ্যেই নগরীতে পৌঁছার পর একটি নিয়ে যাওয়া হয় মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের অদূরে কুমারপাড়াস্থ একটি সার্ভিসিং সেন্টারে। অপরটি রাখা হয় নগরীর শাহজালাল উপশহরের প্রিং টাওয়ারের গ্যারেজে। কিন্তু দিনদুপুরে গাড়ি দু’টি এসব স্থানে নিরাপদে রাখা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এগুলোর সন্ধান পায় মধ্যরাতে। তাও আবার এক সংবাদকর্মীর দেয়া তথ্যে। অনুপ্রবেশকারী গাড়ি দু’টি উদ্ধারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে উঠে অনুপ্রবেশকারী তিনজনকে আটকে। ভারতীয় ইমিগ্রেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী যাদের সবাই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক।
তাদের আটকাতে ইতোমধ্যে পাসপোর্ট নম্বার ও ছবি প্রেরণ করে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে দেশের সবক’টি বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও শুল্কস্টেশন কর্তৃপক্ষের হাতে। কিন্তু ঘটনার চারদিন অতিবাহিত হলেও তাদের কোনো সন্ধান মিলেনি।
সিলেটের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা জানিয়েছেন, তাদের ধরতে পুলিশ ও গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছে। তবে, একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অবৈধভাবে গাড়ি নিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের রক্ষায় ব্যস্ত রয়েছেন এক সংসদ সদস্যসহ সরকার দলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। লন্ডন-বাংলা ফোনই এদের রক্ষায় ক্ষমতাসীনদের ব্যস্ত করেছে।
সূত্রমতে, অনুপ্রবেশকারীদের একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক কাবুল মিয়া। সিলেটের বিশ্বনাথের বাসিন্দা ওই কাবুল মিয়া ভারত হয়ে একাধিকবার গাড়ি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। এক বছর আগেও অর্থাৎ ২০১২ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি একটি পাজেরো গাড়ি নিয়ে সুতারকান্দি শুল্কস্টেশন দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তবে, এজন্য কোনো ধরনের শুল্ক দিতে হয়নি তাকে। ভারতের কাস্টমসের কাছে এ তথ্য থাকলেও বাংলাদেশের কাস্টমসের কোথাও এর কোন প্রমাণ নেই। অথচ বৃহস্পতিবার ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের সাংবাদিকসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে এ তথ্য দিয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, বিভিন্ন সময় ওই শুল্কস্টেশন দিয়ে দিনে এবং রাতে নতুন পাজেরো, মার্সিডিজসহ বিভিন্ন মডেলের বিলাসবহুল গাড়ি ঢুকতে দেখেছেন।
তবে, সুতারকান্দি কাস্টমস কর্মকর্তারা ওই শুল্কস্টেশন দিয়ে কখনও গাড়ি আসার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তারা জানিয়েছেন, ওই শুল্কস্টেশন দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি-রফতানি করা হয়। এরমধ্যে সাতকরা, সবজি, কমলা, পেঁয়াজ, রসুনসহ বেশ কিছু কাঁচামাল আমদানি এবং ইলিশসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ, প্রাণের পণ্যসহ বেশ কিছু পণ্য রফতানি করা হয়।
কিন্তু গাড়ি আমদানি না হলে কিভাবে বিলাসবহুল এই জিপ দু’টি ওই শুল্কস্টেশনে ঢুকলো এবং বিনাবাধায় অকুস্থল ত্যাগের সুযোগ পেল- প্রশ্নে জবাব দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টদের কেউই। এ ব্যাপারে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজ মকবুল হোসেন ভূঁইয়া জানান, সুতারকান্দি শুল্কস্টেশন দিয়ে বৈধ পথে গাড়ি ঢুকার কোন খবর নেই তার কাছে। নিকট অতীতে কেউ এভাবে গাড়ি নিয়ে এসেছে এ রকম কোন তথ্য পাননি তারা। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে পুলিশ বিস্তারিত খবর নিচ্ছে।
বিজিবির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সঙ্গে সিলেটের সীমান্ত রয়েছে প্রায় ৭শ’ কিলোমিটার। অনুসন্ধানে জানা যায়, সীমান্ত প্রহরী বিজিবির নজর এড়িয়ে সিলেটের বিভিন্ন স্থল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই ঢুকছে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও হেরোইন, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকের চালান। যা বিভিন্ন রুটে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সারা দেশে। ভারত থেকে আসা অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদকের একাধিক চালান ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লোকালয় থেকে বিভিন্ন সময় উদ্ধার হওয়া এসব অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদকের চালান ভারত থেকে এসেছে। এরসঙ্গে আন্তঃদেশীয় চোরাচালানচক্র জড়িত বলেও ধারণা তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমার জানা মতে, ভারতের সীমান্ত এলাকায় মাদকদ্রব্যের উৎপাদন হয়ে থাকে। সহজলভ্য হওয়ায় ভারতীয় মাদকের চাহিদাও এদেশে বেশি। এছাড়া ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ মজুদ রয়েছে। মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র, গোলাবারুদের চালান মূলত সীমান্ত এলাকা দিয়ে এদেশে আসে। তাঁর মতে, সীমান্ত ক্রস হওয়ার আগেই বিজিবি সদস্যরা ব্যবস্থা নিলে এগুলো ছড়িয়ে পড়তো না। সীমান্তে বিজিবি জওয়ানদের আরও কঠোর না হলে আগামীতে নির্বাচন ও দেশের উত্তাল পরিস্থিতিতে সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেশে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে অভিযানে যারা ধরা পড়ে তারাও স্বীকার করে, সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে তারা এগুলো এনেছে।
সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্রের প্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত এলাকায় পুলিশের বাড়তি নজরদারি রয়েছে। পুলিশ মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের আটক করছে। তবে, সিলেটের কোন কোন সীমান্ত দিয়ে এগুলো আসে এর কোন তালিকা নেই পুলিশের কাছে।
তবে, সীমান্ত প্রহরীদের কঠোর নজরদারি থাকার পরও এগুলো কিভাবে বাংলাদেশে ঢুকছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সচেতন মহলের কাছে এখন এই প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশবাদী সংগঠক অ্যাডভোকেট সমর বিজয় সী শেখর বলেন, সীমান্ত প্রহরীদের অসতর্কতার কারণেই মূলত সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। বিজিবি জওয়ানরা সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন এবং সীমান্তে টহল ও নজরদারি জোরদার করার পাশাপাশি আন্তঃদেশীয় চোরাকারবারী, অপরাধীদের তালিকা করে তাদের আটক অভিযান শুরু করলে সীমান্ত অপরাধ অনেকটা হ্রাস পেতে পারে।
মানবাধিকার কর্মী ফয়সল আহমদ বাবলুর মতে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল এবং দাঙ্গা হাঙ্গামা দমনে রাজপথে সীমান্ত প্রহরীদের ব্যতিব্যস্ত রাখার কারণেই সীমান্ত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। অরক্ষিত হয়ে পড়ছে বিশাল সীমান্ত এলাকা। বিষয়টি নিয়ে এখনই পদক্ষেপ নেয়া না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button