বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠছে ইসলামি আর্থিক বাজার
আবু আহমেদ:
আলহামদুলিল্লাহ, এখন ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং ইসলামি ফাইন্যান্সিয়াল মার্চেন্ট এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। গত ২৯ অক্টোবর লন্ডনে বিশ্ব ইসলামিক অর্থনীতি ফোরামের (World Islamic Economic Forum) উদ্বোধন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন আমাদের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই প্রধানমন্ত্রীরা এবং অর্থমন্ত্রীরা ওই সম্মেলনে যোগ দেন। এই প্রথম ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা ও এই আর্থিক বাজারের সম্ভাবনাকে ব্যাপকভাবে জানার সুযোগ হলো এই বিষয়ে গবেষক এবং ব্যবহারকারীদের।
এই সম্মেলনে মুসলিম স্কলারস এবং অমুসলিম স্কলারদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। আরো এসেছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে পাঠদান করেন এমন অধ্যাপকেরা এবং গবেষণা করেন এমন ছাত্ররা। এত দিন ইসলামি ফাইন্যান্সের ব্যাপারটা শুধু মুসলমানদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে এবং মুসলিম দেশগুলোর স্কলারদের অধ্যয়নের বিষয় ছিল। আর আজ এই বিষয়টি নন-মুসলিম স্কলারস ও দেশগুলোর একটি অতি আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ইউরোপের দরজা ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার জন্য অনেক আগেই উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এখন যেটা শুরু হয়েছে সেটি হলো কোন দেশ কতটা বেশি এই ব্যবস্থাকে দেশের জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারবে তার প্রতিযোগিতা। ইতোমধ্যে প্যারিস ও লন্ডন ইসলামি ফাইন্যান্সের বড় কেন্দ্র হিসেবে উদ্ভব হয়েছে। ইংরেজ জাতি অতি বুদ্ধিমান বটে। না হলে যেখানে অনেক মুসলিম দেশেও এই বাজার এখনো ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সেখানে তারা নিজ উদ্যোগে কেন প্রথম World Islamic Economic Forum-এর শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠান করতে গেল। এর মাধ্যমে ডেভিড ক্যামেরন ঘোষণা করলেনÑ সামনের দিনগুলোতে লন্ডন হবে ইসলামি অর্থনীতির বড় হাব বা কেন্দ্র। সত্যিই তা হবে বলে আমাদেরও বিশ্বাস। কারণ ওদের উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থাকে বর্তমানে প্রচলিত সুদভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থার একটি সমান্তরাল বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হবে।
যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও Financial Service Authority (FSA) ইতোমধ্যে ইসলামি ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। ডেভিড ক্যামেরন ঘোষণা করলেন শিগগিরই যুক্তরাজ্যে শরিয়াভিত্তিক ইসলামি ব্যাংক যা সুকুক (Sukuk) হিসেবে পরিচিত ছাড়া হবে। ওই ব্যাংকে মুসলিম, অমুসলিম সবাই বিনিয়োগ করতে পারবে। তিনি এ-ও ঘোষণা করলেন যে অদূর ভবিষ্যতে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ (LSE) শরিয়াসম্মত শেয়ারগুলোকে নিয়ে একটি শরিয়া কমপ্লিয়েন্ট (Sharia Complient) ইনডেক্স (Index) বা সূচক নির্মাণ করবে যাতে করে যারা সুদ থেকে দূরে থাকতে চান এবং যারা হালাল প্রডাক্টস উৎপাদন করেন এমন সব কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারে। ইসলামি ব্যাংক ছাড়াও LSE-তে শরিয়াসম্মত ইনডেক্স চালু করা হবে ইসলামি অর্থনীতির সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। উল্লেখ্য, যে বাংলাদেশসহ অনেক মুসলিম দেশেও সুকুক ইস্যুকারী এবং স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে আছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ইসলামী বন্ড বা ট্রেজারি বিলস চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার এই পর্যন্ত যত বন্ড ও সঞ্চয়পত্র বা সঞ্চয় হাতিয়ার বিক্রয় করছে ওইগুলো কোনোটাই সুকুক বা ইসলামি বন্ডের পর্যায়ে পড়ে না। ফলে যেসব লোক সুদকে পরিহার করে চলতে চায় তাদের জন্য আপাতত বিকল্প হলো ইসলামি ব্যাংকগুলোতে প্রফিট লস (PLS) হিসেবে অর্থ রাখা বা এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ইস্যু বন্ডগুলোতে বিনিয়োগ করা। উল্লেখ্য, Sukuk বা ইসলামি বন্ড যে উদ্দেশ্যে এবং যে শর্তে ইস্যু করা হয় সেই উদ্দেশ্যে আজতক কোনো সুকুক বাংলাদেশে ইস্যু করা হয়নি। তবে আমরা শুনেছি যুক্তরাজ্যের মতো প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার সুকুক ইস্যু করবে। বাংলাদেশে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (DSE এবং CSE) শরিয়াসম্মত একটা ওহফবী চালু করবে বলে শুনে আসছি। এটি করতে পারলে যারা শরিয়া মেনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চায় তাদের জন্য সেই ধরনের বিনিয়োগ সহজ হবে। পাশের দেশ ভারতের বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জও সেই দেশের ১৬ কোটি মানুষকে শেয়ারবাজার তথা ইক্যুইটি বাজারে উৎসাহ দেয়ার জন্য বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে একটা Islamic Index চালু করেছে । তবে ভারত এ পর্যন্ত কোনো ইসলামী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কাজ করার অনুমতি দেয়নি। এটি ভারতের নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতা বটে। মালয়েশিয়া ও দুবাই ইসলামি আর্থিক বাজার গঠনের ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রশ্ন হতে পারে ইসলামি আর্থিক বাজারের হাতিয়ারগুলোর গ্রাহক কারা? উত্তর হলো, প্রথমদিকে শুধু
মুসলমানেরা এসব হাতিয়ারে বিনিয়োগ করলেও এখন অন্যরাও এসব হাতিয়ারে বিনিয়োগ করছে। এক হিসাব মতে ইসলামি আর্থিক বাজারের সাইজ বা পরিমাণ হলো প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। এই বাজারের আয়তন বার্ষিক ২৫ শতাংশ করে বাড়ছে । আজ যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে অতি খুশির সাথে ঘোষণা করলেন যে শিগগিরই ব্রিটিশ সরকার সুকুক ইস্যু করবে ওই সুসুকের গ্রাহকও হবে সেই ব্রিটিশ মুসলমানেরা, ব্রিটিশ সাদা ও কালো লোকেরা এবং বিদেশী মুসলিম ও নন-মুসলিম বিনিয়োগকারীরা। এর অন্য অর্থ হলো সুদবিহীন আর্থিক হাতিয়ারগুলো এখন নন-মুসলিমেরাও গ্রহণ করছে এবং এসব হাতিয়ার মুনাফা দেয়ার দিক দিয়ে অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক। এক সময় ছিল যখন কিছু মুসলিম স্কলার ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় ওই ব্যাপারে তাত্ত্বিক ভিত্তিটা পত্তন করেছিলেন। সেই সময় ছিল গত শতাব্দীর আশির দশকের প্রথম বছরগুলো। তখন এসব স্কলারদের কাজকে অন্য লোকেরা নাক সিঁটকাতো এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বলত, ‘আরে সুদবিহীন আর্থিক ব্যবস্থাও কি সম্ভব! তারা সুদবিহীন আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে ধর্মের প্রয়োজনকে দেখতে পেত এবং এই হলো কিছু সম্পদশালী লোকের প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার ফসল। আজকে অবস্থাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আজকে কিছু বিশ্বাসী মুসলিম স্কলারদের কাজকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। আজকে ইসলামি অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থা বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও পাঠ্যসূচির বিষয়বস্তু। যদিও সুদবিহীন আর্থিক ব্যবস্থার আদি উদ্যোক্তারা ছিল মুসলিম স্কলারেরা তবুও আজকে এই ধারণা আন্তর্জাতিকতা লাভ করেছে। সুদবিহীন আর্থিক ব্যবস্থাপনা চালনার জন্য বিশ্বাসে যে মুসলমান হতে হবে সেটি আবশ্যক নয়। সুদবিহীন আর্থিক ব্যবস্থাপনার অর্থ উন্নততর যে এই ব্যবস্থায় যিনি অগ্রণী ছিলেন তিনিও বিনিয়োগ ও ব্যবসার ঝুঁকির অংশীদারী হলেন। অন্য কথায় এই ব্যবস্থা একটি অংশীদারিত্বের ব্যবস্থা। বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থায় ধসের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যেসব প্রতিষ্ঠান সুদবিহীন কাঠামোর ওপর চলছে ওইগুলো ধসে পড়েনি এবং ওইগুলোতে যারা বিনিয়োগ করেছে তারা নিরাপদে আছে।
লেখক-অর্থনীতিবিদ