কওমি মাদরাসা যেভাবে আছে সেভাবে চলতে দিন

আবু আহমেদ:
আজকাল আলেমে দ্বীনের সংখ্যা কমে গেছে। ওই সব আলেমে দ্বীন, যারা নিজেরা আধ্যাত্মিকতার শিখরে উঠে এই জমিনে মানুষকে দ্বীনের পক্ষে অতি নিঃস্বার্থভাবে আহ্বান করাকে নিজেদের ঈমানি দায়িত্ব বলে গ্রহণ করে নিয়েছেন। আমাদের ছোটকালে আমরা বহু আলেমে দ্বীনের কথা শুনেছি, যারা মানুষ কে আল্লাহর পথে ডেকেছেন, যারা মাদরাসাগুলোতে দ্বীন শিক্ষা দিয়েছেন, যারা ইসলামের ওপর কোনো আঘাত এলে রুখে দাঁড়িয়েছেন। এখন অনেক লোক আছেন যারা মাদরাসা সনদধারী, কিন্তু তাদের মধ্যে এলেম, আমল কোনোটাই নেই। তারা হয়ে পড়েছেন দুনিয়াপন্থী আলেমের পোশাক পরিহিত কিছু লোক। এসব আলেম নামধারী লোক সরকার থেকে কিছু অর্থকড়ি পাওয়ার জন্য এক ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সরকারী অর্থ পেলে এরা মাদরাসাগুলোকে ইসলামবিবর্জিত বিদ্যালয়ে রূপান্তর করতেও পিছপা হবে না। এ ধরনের আলেমের লেবাসে দুনিয়াপন্থী লোকদেরকে সরকারি আলেম বলেই মানুষ চেনে। এদের থেকে দ্বীনশিক্ষা আশা করা যায় না। লোকদের কাছে জীবনের আলো ছড়ানোর সেই ক্ষমতাও এদের নেই। এ সব লোকই কওমি মাদরাসাগুলোর সংস্কার চায়, সেখানে যা শিক্ষা দেয়া হচ্ছে সেগুলোতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ চান। এদের উদ্দেশ্য হলো পাওয়ার বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা এবং যে সংযোগের মাধ্যমে সরকারের দেওয়া খুদকুঁড়ো খাওয়া।
হঠাৎ করে কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি কেন প্রয়োজন হয়ে পড়ল? সনদের স্বীকৃতির পেছনে সরকারের কোনো শুভ উদ্দেশ্য আছে বলে জনগণ মনে করে না। ওই সনদের স্বীকৃতির মাধ্যমে একদিন দেখা যাবে কওমি মাদরাসা আর কওমি মাদরাসা নেই, সেগুলো হয়ে পড়েছে সরকার কর্তৃক রচিত সিলেবাস অনুসরণ করে পাঠদানের কথিত ইসলামি স্কুল। সরকার দ্বীন শিক্ষাকে প্রকৃত দ্বীনি অবস্থায় থাকতে দেবে এটা কেউই বিশ্বাস করে না। আগে সরকারি মাদরাসাগুলোতে কিছুটা হলেও দ্বীনি শিক্ষা দেয়া হতো। কিন্তু আধুনিকীকরণের নামে সেগুলোতে সিলেবাসের এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করা হলো, যার ফলে এখন অন্য বিদ্যা শিক্ষা দেয়া হলেও কুরআন-হাদিসের শিক্ষা অনেকটা পেছনে চলে গেছে। কোনো সরকারি মাদরাসা থেকে বর্তমানে আলেমে দ্বীন তৈরি হয় এটা কেউ বিশ্বাস করে না। ওই সব মাদরাসার শিক্ষকের মধ্যে আলেমের চিহ্ন অতি সামান্যই আছে। তারা হয়ে পড়েছে সরকার থেকে আরো বাড়তি কিছু আর্থিক সুবিধা কিভাবে পাওয়া যায় সেই ব্যাপারে সদা উদগ্রীব কিছু দুনিয়াপন্থী লোক। কিন্তু দেশের জনগণের বিরাট একটা অংশ চায় এমন আলেমে দ্বীন, যারা নিঃস্বার্থভাবে জনগণকে কুরআনের পথে ডাকবে এবং নিজেরা দ্বীনের ওপর পূর্ণাঙ্গভাবে স্থির থাকবে। এসব আলেম হবেন আধ্যাত্মিকতার মূর্তপ্রতীক। এদের কাছে লোকজন এলে শুধু আলোই পাবেন।
কওমি মাদরাসার সংখ্যা এখন অনেক। এসব মাদরাসা গড়ে উঠছে জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে এবং জনগণের দানে। যেসব মাদরাসায় সরকার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিতে শুরু করেছে, ওই সব মাদরাসা থেকে জনগণ তাদের সমর্থন তুলে নিয়েছে। সত্যি হলো, কোনো মাদরাসা এমপিওভুক্তির পর ওই মাদরাসার পাশে আর একটি কওমি মাদরাসা গড়ে উঠেছে। এর কারণ কী? কারণ হলো মানুষ মনে করে পূর্বের মাদরাসা যখন এমপিওভুক্ত হয়ে গেছে, তখন সেখানে দ্বীনি চর্চা হবে না, দ্বীনি চর্চা ও দ্বীনি এলেমের জন্য বিকল্প মাদরাসা দরকার, আর সেটা হলো ওই কওমি মাদরাসা। প্রশ্ন হতে পারে সরকার তো জনগণের টাকাই শিক্ষা বিস্তারের নামে অন্যসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খরচ করছে। কওমি মাদরাসাগুলো তো সেই দেশেরই প্রতিষ্ঠান, তা হলে সেগুলোতে সরকারি দান-অনুদান নিতে অসুবিধা কোথায়?
আমি কোনো অসুবিধা দেখি না। তবে এই ক্ষেত্রে শর্ত থাকতে হবে যে, অন্য ব্যক্তিশ্রেণীর লোকেরা যেভাবে এগুলোতে তাদের দান-সাদকা করে থাকেন, সেভাবে সরকার যদি এগুলোকে অনুদান হিসেবে বার্ষিক কিছু অর্থ দেয় তা হলে কোনো আপত্তি থাকবে না। এর অন্য অর্থ হলো, সরকার কওমি মাদরাসার সিলেবাসে কোনো হাত দিতে পারবে না এবং ওইসব মাদরাসার পরিচালনা কমিটিতেও হাত দিতে পারবে না। অন্য প্রশ্ন হলো, কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি দিতে হবে কেন? সরকারি স্বীকৃতি পেলে ওই সনদ মূল্যবান, আর সরকারি সনদ না পেলে এটা মূল্যহীনÑ এ কথাইবা কে বলেছে? অন্য প্রশ্ন হলো, সরকারি স্বীকৃতি ছাড়া তো ওই সব সনদকে চাকরি ক্ষেত্রে কিংবা উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনার কোনো সুযোগ নেই। হ্যাঁ, এটা সত্যি বটে। তবে বড় সত্য হলো, যারা কওমি মাদরাসায় পড়ে এবং পড়ান তারা নিজেরাই এ ধরনের স্বীকৃতি ও সুযোগ চান না। তাদের কথা হলো, এসব স্বীকৃতির ফল হবে পর্যায়ক্রমে সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া, শেষ পর্যন্ত কওমি মাদরাসা আর কওমি থাকবে না। ওগুলোও সরকারি মাদরাসার স্তরে চলে যাবে। অন্য কথা হলো, তারা যে শিক্ষা দিচ্ছেন এবং নিচ্ছেন সেই শিক্ষা তো তাদের দুনিয়াতে সম্মানজনকভাবে চলার পথ থেকে দূরেই রেখে দিচ্ছে। তাদের মাদরাসাগুলোতে কিছুটা কারিগরি, কিছুটা অঙ্কশিক্ষা দিলে ক্ষতি কী। এসব শিক্ষাও সেগুলোতে দেয়া যেতে পারে, তবে তা তাদের স্বইচ্ছায় ও স্বউদ্যোগে হতে হবে। সরকার ওইগুলোতে অঙ্ক, বিজ্ঞান শেখাতে গেলে প্রশ্ন আসবেই। দুটো বিষয়ে আমাদের অবগত থাকতে হবে, সেটা হলো, শুধু দ্বীনি শিক্ষার জন্যই এই মাদরাসাগুলো গড়ে উঠেছে। বলা চলে প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষার জন্য। এগুলোতে উচ্চতর গবেষণা হবে এমনটি কেউ আশা করে না। প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষার একটা বিরাট চাহিদা আছে, যা এসব মাদরাসা পূরণ করছে। এখন বেশির ভাগ মসজিদের ইমাম ও খতিবেরা কওমি মাদরাসার শিক্ষিত আলেমেরা। মক্তবের শিক্ষকেরাও এসেছেন কওমি মাদরাসা থেকে। গরিব-এতিম ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাও করছে কওমি মাদরাগুলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকার ধর্মীয় শিক্ষার জন্য অর্থ-কড়ি ব্যয় করে। বাংলাদেশ সরকার যদি তার বার্ষিক শিক্ষা বাজেট থেকে এসব মাদরাসায় অনুদান দিতে চায় তাহলে সেটা অবশ্যই করতেপারে।
কওমি মাদরাসাগুলোর মধ্যে যেগুলো প্রাচীন ও সুপ্রতিষ্ঠিত সেগুলো নিজেরাই নিজদের সনদ দিতে পারে। অন্য ছোট মাদরাসাগুলোর জন্য একটা পরীক্ষা বোর্ড, সেই বোর্ডও কওমি মাদরাসার আলেমেরাই গঠন করে নিতে পারেন। অনেকেই প্রশ্ন করেন, কওমি মাদরাসায় পড়া মানে দরিদ্র থেকে যাওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো ওই ধরনের সম্ভাব্য দরিদ্রতাকে মেনে নিয়েই ওই সব মাদরাসার ছাত্ররা শুধু দ্বীনি এলেম শিক্ষার জন্য সেখানে ভর্তি হচ্ছে। ওই সব মাদরাসার ছাত্রদের কাছে ‘হুজুরেরা’ হলো তাদের আদর্শ। অন্য বিষয় হলো, বিশ্বের কোথাও একমুখী এক সিলেবাসের লেখাপড়া নেই। আমাদের দেশেও এই ভিন্নতাকে মেনে নিতে হবে। হ্যাঁ, এটাও সত্য, ইউরোপ ও আমেরিকার খ্রিষ্টান যাজকেরাও তো বিজ্ঞান প্রযুক্তিতেও অনেক শিক্ষিত। আমাদের দেশে যেহেতু সমাজ সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে পিছিয়ে আছে, সেজন্য আমাদের ধর্মীয় আলেমদের থেকে ওই বিজ্ঞান প্রযুক্তির জ্ঞান আশা করা যায় না। আসলে অনেক লোকই ধর্মীয় গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করেন বটে, তবে সেগুলোতে জীবনের জন্য যে নির্দেশনা দেয়া আছে সেই নির্দেশনা পালনে তারা মোটেই আন্তরিক নন।
আমরা এমন লোককেও দেখেছি, যিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ডিজি কিন্তু নামাজের সময় অন্য লোকের সাথে গল্প করতে ব্যস্ত। আবার এমন অনেক অধ্যাপক আছেন যারা ইসলামি স্টাডিজ শিক্ষা দেন, কিন্তু নিজেরা নামাজ পড়েন না। এদের শিক্ষা ও বিশ্বাস ভিন্ন জায়গায় পড়ে আছে। কওমি মাদরাসার প্রধানকে মোহতামিম, বড় হুজুর, আউয়াল হুজুরÑ এসব নামে ডাকা হয়। সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে হুজরদের টাইটেল হয় প্রিন্সিপাল, অধ্যক্ষ। যখন থেকে মোহতামিম, বড় হুজুর, আউয়াল হুজুর প্রিন্সিপাল টাইটেল ধারণ করেন তখন থেকে দ্বীনি শিক্ষার অবনতি শুরু হয়ে যায়। যে ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিয়ে ছাত্ররা তাদের বড় হুজুরকে দেখত, সে শ্রদ্ধাভক্তি উঠে যেতে থাকে এবং এক দিন সেই বড় হুজররাও অনেকটা দুনিয়ামুখী প্রিন্সিপাল হয়ে ওঠেন। এমন অনেক দুনিয়ামুখী মাওলানা দেখা যায়। এরা বিভক্তি করা এবং সরকারের খুদকুঁড়ো খাওয়ার জন্য ব্যস্ত। এরাই ইমামতির ক্ষেত্রে, ইমাম নিয়োগের ক্ষেত্রে জোর জবরদস্তি করেন এবং নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য ‘পন্থী’ হয়ে পড়েন। আমাদের ছোটকালে অনেক বিখ্যাত আলেমে দ্বীনের কথা আমরা শুনেছিলাম। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতহার আলী, ফরিদপুরের সামছুল হক ফরিদপুরী, চট্টগ্রামের মাওলানা সিদ্দিক আহমেদ আজাদ। পরে যাদের কথা শুনে এসেছি তারা হলেন, বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব মাওলানা মরহুম ওবায়দুল হক, মরহুম মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর, মরহুম মাওলানা আমিনুল ইসলাম, মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনী, শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক।
আমার জানা মতে, এরা সবাই কওমি মাদরাসা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত। সরকারি মাদরাসাগুলো থেকে বড় আলেম তৈরি হয়েছে এমন উদাহরণ খুবই কম। অন্য দিক হলো, সরকারি স্বীকৃতির সাথে সরকারি অর্থের সংযোগ থাকবে। আর সরকারি অর্থ যেখানেই গেছে সেখানেই দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ওই সব প্রতিষ্ঠান বেএলমি ও বে আমলিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button