দাওয়াত ও তাবলিগের নববি নীতি
সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ.):
ইসলাম এক ঐশী জীবনবিধান আর মুসলিম উম্মাহ হলো সে জীবনবিধানের ধারকবাহক। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মুসলিম জনসাধারণই শুধু নয় বরং ওলামা-মাশায়েখরা পর্যন্ত অবহেলা উদাসীনতায় এ মহাসত্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে পড়েছেন। ফলে মুসলমানরাও আজ পৃথিবীর অপরাপর জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তার সংজ্ঞা অনুসারে নিজেদের নিছক একটি জাতি রূপে ধারণা করে থাকে। একদল তাদের জাতীয় সত্তার সৌধ নির্মাণ করেছে ভৌগোলিক সীমারেখার ওপর, আর অন্য দল ভাষা, বর্ণ বা রক্ত বৈশিষ্ট্যের ওপর, মুসলিম সমাজে যাদের কিছুটা বোধ ও বুদ্ধি আছে তারা খুব বেশি হলে এই মনে করেন, মুসলমানদের জাতিসত্তা অঞ্চল ও ভাষাভিত্তিক নয় বরং ধর্মভিত্তিক।
অথচ প্রকৃত সত্য তাদেরও চিন্তা রেখার বহু ঊর্ধ্বে। আর তা এই, মুসলমান হলো পৃথিবীর বুকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক বিশেষ পয়গাম বহনকারী জামায়াত, যাদের একমাত্র জীবন কর্তব্য হলো এ পয়গামকে রক্ষা করা এবং সার্বজনীন দাওয়াতের মাধ্যমে মানব সমাজে এর প্রসার ঘটানো। এ পয়গাম ও জীবনবিধান গ্রহণকারীরা ভাষা, বর্ণ ও ভৌগোলিকতার ঊর্ধ্বে সুনির্দিষ্ট দায়-দায়িত্ব সম্পন্ন এক বৃহত্ পরিবারভুক্ত। এ পরিবার-বন্ধনই হলো তাদের জাতীয়তা এবং এখানেই মুসলিম জাতীয় সত্তার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য। এই পরম সত্য অনুধাবণের পর মুসলিম উম্মাহর সর্বপ্রধান কর্তব্য হলো, পূর্ণ জ্ঞান অর্জনপূর্বক এই আসমানি পয়গামের অনুসরণ করা, তালিম ও দাওয়াতের মাধ্যমে এর প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করা এবং এর অনুসারীদের নিয়ে পূর্ণ দায়িত্বমূলক সার্বজনীন ভ্রাতৃ-পরিবার গঠন করা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, মাত্র এক শতাব্দীর সময় ব্যবধানেই মুসলিম উম্মাহ তাদের এই জাতীয় দায়িত্ব বিলকুল ভুলে গিয়েছিল। একদিকে শাসকবর্গ দেশ জয় ও শাসনে তুষ্ট ছিল, আলিম-ওলামা ও জ্ঞানসেবীরা পঠন-পাঠন নিয়ে পরিতৃপ্ত ছিল আর অন্যদিকে সূফি-দরবেশরা খানকার ভাবগম্ভীর পরিবেশেই আত্মসমাহিত ছিল। ফলে নেতৃত্ব ও পথনির্দেশনাহীন মুসলিম উম্মাহ তার নিজস্ব অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে গাফেল বেখবর হয়ে গেল এবং সব শ্রেণীর দৃষ্টিপথ থেকে তাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হারিয়ে গেল।
মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব
কোরআন সুন্নাহর প্রত্যক্ষ বাণী ও নির্দেশ থেকে এটা প্রমাণিত, মুসলিম উম্মাহ তাদের প্রিয় নবী মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুবর্তিতায় বিশ্বের সব জাতির কল্যাণ ও হিদায়েতের উদ্দেশ্যেই প্রেরিত এবং বিশ্বসভ্যতায় ‘আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার’-এর সুমহান দাওয়াতি দায়িত্ব পালনের জন্য উত্থিত। তাই আল কোরআন পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছে, ‘তোমরা হলে শ্রেষ্ঠ উম্মত, যাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে মানুষের (কল্যাণের) জন্য। তোমরা সত্ কাজে উদ্বুদ্ধ করবে এবং মন্দ কাজ হতে নিবৃত্ত করবে’। [আলে ইমরান]
মুসলিম উম্মাহ নবীর স্থলবর্তী
নবুওতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার। এ ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ হলো নবীর স্থলবর্তী। তাই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আহকাম ও হিকমতের তালিম এবং আত্মসংশোধনের যে তিনটি নববী দায়িত্ব দান করা হয়েছে এগুলো মুসলিম উম্মাহর ওপর ফরজে কিফায়ারূপে অর্পিত হয়েছে এবং যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহর বরেণ্য ইমামরা পূর্ণ নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতার সঙ্গে এগুলো আঞ্জাম দিয়ে এসেছেন।
দাওয়াত ও তাবলিগের নববী রীতি
প্রথম মূলনীতি : আম্বিয়ায়ে কেরাম দাওয়াত ও তাবলিগ এবং মেহনত ও মুজাহাদার মূল বুনিয়াদই ছিল, আপন শ্রম ও পরিশ্রমের দান ও প্রতিদান কোনো মাখলুকের কাছে তারা আশা করেন না। ‘এ দাওয়াতি মেহনতের কোনো বিনিময়ে তোমাদের কাছে আমি চাই না। আমার প্রতিদান তো দেবেন আল্লাহ তায়ালা’ [সূরা-১০৯]।
দ্বিতীয় মূলনীতি : তাদের দ্বিতীয় চালিকাশক্তি হলো মানব প্রেম ও মানব কল্যাণের আকুতি। পথহারা মানুষের বরবাদি-আশঙ্কায় হৃদয় তাদের যন্ত্রণাদগ্ধ হয়। ‘আপন প্রতিপালকের বাণী আমি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি, আমি তোমাদের কল্যাণকামী, বিশ্বস্ত’ [আরাফ-৬৭]।
তৃতীয় মূলনীতি : সহজ-সরল ও সুকোমল আচরণ এবং আন্তরিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ সম্ভাষণ যাতে শ্রোতা দাঈর ইখলাস, আন্তরিকতায় ও সুহৃদয়তায় বিমুগ্ধ হয় এবং ভালোবাসার উত্তাপে তার হৃদয় মোমের মতো গলে যায়। ‘তোমরা উভয়ে তার সঙ্গে নরম কথা বলবে’ [ত্বহা-৪৪]।
চতুর্থ মূলনীতি : দাওয়াত ও তাবলিগের ক্ষেত্রে ক্রম গুরুত্বপূর্ণতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্থাত্ প্রথমে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দাওয়াত দিতে হবে, এরপর তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এভাবে ক্রমান্বয়ে। এ কারণেই দাওয়াত ও তাবলিগের শুরুতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওহিদ ও রিসালাতের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন।
পঞ্চম মূলনীতি : রাসুলের পবিত্র জীবন চরিত্রে দাওয়াত ও তাবলিগের সেসব মূলনীতি বিশিষ্টতা লাভ করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘দাওয়াত নিবেদন’। অর্থাত্ মানুষের আগমনের প্রতীক্ষায় না থেকে দূত ও বার্তাবাহকদের দুয়ারে দাওয়াত পাঠিয়ে দিতেন। ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা নিজেদের হিফাজত ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা কর এবং আলাদা আলাদাভাবে কিংবা দলবদ্ধভাবে ঘর থেকে বের হও’ [নিসা-৭১]।
ষষ্ঠ মূলনীতি : ইসলামী দাওয়াত ও তাবলিগের আর একটি বড় মূলনীতি হলো অভিযাত্রা। অর্থাত্ দ্বীনের সন্ধানে স্বদেশ ও স্বজন ছেড়ে বের হয়ে পড় এবং যেখানে দ্বীন হাসিল করা সম্ভব, সেখানে গিয়ে হাজির হওয়া। আবার ফিরে এসে স্বজাতির মাঝে দ্বীনের ফরজ বিস্তার করা।
তাবলিগ ও দাওয়াতের গুরুত্ব
হিকমতপূর্ণ দাওয়াত ও তাবলিগ তথা আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার হলো ইসলামের মেরুদণ্ড। ইসলামের ভিত্তি, শক্তি, ব্যাপ্তি ও অগ্রগতি—সবকিছু এরই ওপর নির্ভরশীল এবং অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় আজ এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। এটা অনস্বীকার্য সত্য, অমুসলমানকে মুসলমান করার চেয়ে নামের মুসলমানকে কাজের মুসলমান বানানো এবং জাতীয় পরিচয়ের মুসলমানকে ধর্মীয় পরিচয়ের মুসলমান রূপে গড়ে তোলা অনেক বেশি জরুরি ও আবশ্যক। মুসলিম উম্মাহর বর্তমান দুরবস্থা ও মর্মন্তুদ অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোরআনের এ উদাত্ত আহ্বান—হে ঈমানদাররা! তোমরা ঈমান আন [সূরা নিসা-১৩৬]। সর্বশক্তিযোগে প্রচার করাই হলো সময়ের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। দেশে দেশে, শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে এবং দ্বারে দ্বারে ঘুরে মুসলমানকে মুসলমান বানানোর দাওয়াতি মেহনতেই আজ আত্মনিয়োগ করতে হবে। এমন মেহনত, মুজাহাদা এবং ত্যাগ ও কোরবানি আমাদের পেশ করতে হবে, যা দুনিয়ার লোকরা দুনিয়ার তুচ্ছ মান-সম্মান ও ক্ষণস্থায়ী ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য করে থাকে। ত্যাগ ও কোরবানির জযবা থেকেই মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় উদ্দেশ্যের পথে প্রিয় সবকিছু বিসর্জনের এবং বাধার বিন্ধাচল অতিক্রমের এক অপরাজেয় শক্তি। ত্যাগ ও কোরবানির এ পথেই আজ আমাদের অগ্রসর হতে হবে সুদৃঢ় পদক্ষেপে। নিজেদের মাঝে এমন কর্মোন্মাদনা সৃষ্টি করতে হবে, যা ছাড়া দ্বীন বা দুনিয়ার কোনো কাজ না কখনও হয়েছে আর না কখনও হবে।
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আনিসুর রহমান