ডিগ্রি ছাড়াই খালি হাতেই দেশে ফিরছেন অসংখ্য মেধাবী স্টুডেন্ট

UK BA২০০৯ সালের শুরুর দিকে স্রোতের মতো ছাত্রছাত্রীরা এসেছে ব্রিটেনে। এই রাস্তাতে সামিল ছিলেন বাংলাদেশি স্টুডেন্টরাও। পয়েন্ট-নির্ভর ভিসা পদ্ধতির কারণেই স্টুডেন্ট ভিসায় ব্রিটেনে আসার সুযোগটি তৈরি হয়েছিলো। আর এই সুযোগে ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণেই ব্রিটেন তার অর্থনৈতিক মন্দায় হাজারো মিলিয়ন পাউন্ড ব্যবসা করতে পেরেছে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশ থেকে। আর এখন সেই স্টুডেন্টদেরই মিডিয়ায় উল্লেখ করা হচ্ছে ভুয়া স্টুডেন্ট, বোগাস স্টুডেন্ট হিসেবে, যাদের সংখ্যা অগণন-অসংখ্য। দেশে থেকে যারা ব্রিটেনে পড়তে এসেছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন মেধাবী স্টুডেন্ট। তাদের সামনে ছিলো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি। কিন্তু ব্রিটেনে সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে তারা হারিয়ে বসেছেন সবকিছু। অর্থ রোজগারের নেশায় পড়ে অনেকেই পড়াশোনায় ইতি টেনেছেন। পরবর্তীতে অনিয়মিত স্টুডেন্ট হিসেবে তারা হারিয়েছেন স্টুডেন্ট পরিচিতিটুকুও। একসময় তাদের কেউ কেউ ইমিগ্রেশন রেইডে ধরা পড়েছেন, কেউ কেউ অবস্থা বেগতিক দেখে ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাড়ি জমিয়েছেন, আবার অনেকেই স্বেচ্ছায় ফিরে গেছেন নিজ দেশে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাঁচ বছরের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নিজ নিজ দেশে ফেরত চলে যাওয়া স্টুডেন্টদের সংখ্যা শতকরা আশি ভাগ। এই পরিসংখ্যানে উল্লেখ রয়েছে বাংলাদেশি স্টুডেন্টদের কথা। কিন্তু কোথাও অবশ্য উল্লেখ করা হয়নি, চলে যাওয়া স্টুডেন্টদের অধিকাংশ ব্রিটেনে এসে তাদের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। তারা ফিরে গেছেন একদম খালি হাতে। পড়াশোনায় ডিগ্রি অর্জন তাদের অনেকের ভাগ্যে জুটেনি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও পাওয়া হয়নি তাদের। অন্যদিকে সম্প্রতি স্টুডেন্টদের কাজের সুযোগ সংকুচিত হওয়ার কারণে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন স্টুডেন্ট ভিসার রমরমা সময়ের শেষদিকে আসা স্টুডেন্টরা। এরা এখানে এসে কাজ করার সুযোগটুকুও পাননি। লাখ লাখ টাকা খরচ করে এসে তাদের সম্বল এখন শুধুই দীর্ঘশ্বাস। অসংখ্য ছাত্র বলতে গেলে অর্ধেক ছাত্রছাত্রীই দেখা গেছে, নতুন সেমিস্টারের এনরোলমেন্টকে অযথা ‘ওয়েইস্ট অব মানি’ বা অর্থের অপচয় হিসেবেই মনে করছে। ছাত্রদের কাজ নেই। কলেজ যেখানে, সেখানে কাজের সুবিধা না থাকায় কাজের সন্ধানে দূরে চলে যাওয়ায় অনিয়মিত ছাত্র হয়ে এদের অধিকাংশই ছাত্রত্ব হারিয়েছে। একে তো ব্রিটেনে চাকরির বাজার মন্দা, অন্যদিকে ইমিগ্রেশন নীতির কড়াকড়ির কারণে অনিয়মিত ছাত্রদের কেউ কাজ দিতে চায় না। কারণ একজন অনিয়মিত ছাত্র ইউকে বোর্ডার ফোর্সের কাছে অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট এবং অবৈধ ইমিগ্র্যান্টকে যে বা যারা কাজ দেয়, তাদের প্রতিও আছে কঠোর হুঁশিয়ারি। কোনো প্রতিষ্ঠানে একজন অবৈধ শ্রমিক খুঁজে পেলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার পাউন্ড জরিমানা করা হয়। ইতিমধ্যে অসংখ্য বাঙালি রেস্টুরেন্ট মালিক এ জরিমানা পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছেন। অন্যদিকে ঘোষণা দিয়ে কিংবা ঘোষণা না দিয়ে ব্রিটেনের যে কোনো কলেজের যে কোনো সময়ে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৯ সালে ইউকে পয়েন্ট বেইজড সিস্টেমের (টিয়ার ৪) আওতায় মোট এক হাজার ৯৮৭টি কলেজকে লাইসেন্স দেয় সরকার। যদি ঐ সমস্ত কলেজ সরকারের ক্রাইটেরিয়া মিট করতে না পারে, তাহলে এসব কলেজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এভাবে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায় অসংখ্য কলেজের। কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক ও মানসিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন অসংখ্য স্টুডেন্ট। তখন তাদের পক্ষে ব্রিটেন ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না।  সমস্যার এখানেই শেষ নয়। অর্থ সংকটের কারণেও অনেক স্টুডেন্টদের ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে এসেছে।  এরকম অসংখ্য বাংলাদেশি স্টুডেন্ট রয়েছে যারা এক বছর কলেজে যাওয়ার পর অর্থ সংকটের কারণে টিউশন ফি না দিতে পারায় অবৈধ হয়ে গেছেন। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানা যায়, গত ৩/৪ বছরে আসা স্টুডেন্টের মধ্যে থেকে অন্তত প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি স্টুডেন্টরা ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন বৈধ অথবা অবৈধ পথে। বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিতে খরচ হয়েছে জনপ্রতি ৮শ’ পাউন্ড থকে ২ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত। এখনও অনেক স্টুডেন্ট পাড়ি জমাচ্ছেন ফ্রান্স, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে ওরা।
জানা যায়, ঐসব দেশে অর্থের হাতছানি না থাকলেও আছে অন্তত রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুযোগ। ওই আশ্রয়েই থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা অন্তত কয়েকটা মাস। এভাবে ফ্রান্স পাড়ি দেওয়া এক স্টুডেন্ট বলেন, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে, পড়ালেখা শেষ না করেই স্টুডেন্ট ভিসায় ব্রিটেনে আসা। গত তিন বছর আগে আমি ব্রিটেন এসেছি। এই সময়ে দেশে থাকলে আমার মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন হতো। হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুযোগ পেতাম। কিন্তু ব্রিটেন এসে না আমার পড়াশোনা করা হয়েছে, না হয়েছে অর্থ রোজগার। এখন ফ্রান্সে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে কাটাচ্ছি অনিশ্চিত সময়।
অপর একজন ছাত্র যিনি এই মুহূর্তে ব্রিটেনের একটি ডিটেনশন সেন্টারে আটক রয়েছেন তিনি নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওরা আমাকে দেশে ডিপোর্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, হয়তো আগামী সপ্তাহেই দেশে ফিরে যাবো।
তিনি জানান, স্টুডেন্ট ভিসায় তার ব্রিটেন আসতে খরচ হয়েছে প্রায় চার লাখ টাকা। কিন্তু ফিরে যাচ্ছেন একদম খালি হাতে। মাঝখানে চার বছর চলে যাওয়ায় দেশে ফিরে গিয়ে নিয়মিত স্টুডেন্ট হিসেবে আবার পড়াশোনা শুরু করা তার পক্ষে সম্ভব নয় বলেও তিনি জানান।
অন্যদিকে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আসা রেজওয়ান আহমদ জানালেন, আগামী মাসেই তিনি স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে যাবেন। বলেন, এখানে বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কাজের কোনো অধিকার নেই। দেশে এমন কোনো অর্থ সম্পদও নেই যে দেশ থেকে টাকা এনে পড়াশোনা করবো। সুতরাং চিন্তা করে দেখলাম, দেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।এরকম উপায় না পেয়ে অনেক স্টুডেন্ট দেশে ফিরছেন, অনেকে ফিরে গেছেন, অনেকে ফিরে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন।
ব্রিটেনে বসবাসের সময়ের  হিসাব মিলাতে গিয়ে তাদের একজন বললেন, আমরা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়কে অনিশ্চিত করে তুলেছি। যে সময়টা নিজেকে গড়ে তোলার কথা ছিলো সেই সময় আমরা কাটিয়েছি, কিভাবে ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়া যায় এই চিন্তা করেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শূণ্য হাতেই আমাদের অনেকের ফিরে যেতে হচ্ছে। -বাংলা টাইমস

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button