বাংলাদেশে ৩ কোটি মানুষ পেট পুরে খেতে পায় না : জাতিসংঘ
সাদেকুর রহমান : সরকারের পরিকল্পনায় নেই, দেশের ক্ষুধাক্লিষ্ট জনগোষ্ঠী। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ফিরিস্তি সম্পর্কে নীতি-নির্ধারণী মহল তথা সরকারের যে প্রচারণা চলমান রয়েছে তার সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
দেশে প্রকৃত জনসংখ্যা কত তা যেমন কেউ জানে না, তেমনি জানা নেই ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘হিডেন হাঙ্গার’ কথাটি বেশ প্রচলিত হলেও সে সময় ক্ষুধার্ত মানুষ সনাক্ত বা তাদের কষ্ট লাঘবের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এরপর রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতাসীন হলে দ্রব্যমূল্যের খগড়, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঘরে ঘরে কর্মসংস্থান না করা ইত্যাদি কারণে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার ব্যাপারে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করা হলেও জাতিসংঘ বলছে, বাংলাদেশে আড়াই থেকে তিন কোটি লোক প্রতিদিন পেট পুরে খেতে পায় না। বিপুল এ জনগোষ্ঠী ক্ষুধা নিয়ে দুর্বিষহ দিন কাটায়। গত বছর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) তাদের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্বের ৭০ মিলিয়ন লোক যথেষ্ট পরিমাণ খাবার খেতে পায় না। এর ৯৮ শতাংশই উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষ। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) ২০১২ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক তালিকায় বাংলাদেশ দ্বাদশ অবস্থানে রয়েছেÑ যা আমাদের দেশের মানুষের খাদ্যগ্রহণ থেকে বঞ্চিত থাকার বিপদসংকেতপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়।
জাতিসংঘ ঘোষিত সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) লক্ষ্যসমূহের অন্যতম হচ্ছে ক্ষুধা ও চরম দারিদ্র্য ২০১৫ সালের মধ্যে কমিয়ে আনা। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক যৌথভাবে ‘এমডিজি : বাংলাদেশ অগ্রগতি প্রতিবেদন-২০১২’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ‘দারিদ্র ও ক্ষুধা’ সংশ্লিষ্ট ১ নম্বর এমডিজি অর্জনের পথে অগ্রগামী হয়েছে। ২০১৫ সালের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে দারিদ্র্যসীমা ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনার বিপরীতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০১০ এর হিসাব অনুযায়ী ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জিত হয়। বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে সঠিক ট্র্যাফে অবস্থান করছে বলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৩ এ দাবি করা হয়।
ইউএনডিপি-সরকারের এমডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ক্ষুধাক্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর অনুপাত-২০১৫ সাল নাগাদ ১৯৯০-এর তুলনায় অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কিছুতেই সম্ভব নয়। এ প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট হয়েছে, সরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে নানা রকম কর্মসূচি নিলেও ক্ষুধাক্লিষ্ট জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে ভাবনার বাইরে। নীতি-নির্ধারণী মহল তথা সরকারের পক্ষ থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেই ক্ষুধাক্লিষ্ট জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দাবি না হলেও গবেষক-বিশ্লেষকরা এর ব্যত্যয় খুঁজে পেয়েছেন। প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী নি¤œ জ্ঞানসম্পন্ন শিশুর হার ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে ছিল ৬৬ শতাংশ। বর্তমানে এ হার ৪৫ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা ৩৩ শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। ন্যূনতম খাদ্যশক্তি (১৮০০ কিলো ক্যালোরি)-এর চেয়ে কম পরিমাণে গ্রহণকারী জনসংখ্যার হার ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে ছিলো ২৮ শতাংশ। বর্তমানে এ হার ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৫ নাগাদ এ হার এমডিজি অনুযায়ী ১৪ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কম ওজনের শিশু ২০০৭ সালের ৪১ শতাংশ থেকে কমে ২০১১ সালে ৩৬ শতাংশ দাঁড়ায়। খর্বাকৃতি শিশু ২০০৭ সালের ৪৩ শতাংশ থেকে ২০১১ সালে ৪১ শতাংশে নেমে আসে। আর শিশুর মাতৃদুগ্ধ পানের হার ২০০৭ সালের ৪৩ শতাংশ থেকে ২০১১ সালে ৬৪ শতাংশে উন্নীত হয়। দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির এমন চিত্রে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা এর জন্য দারিদ্র্যের মতোই ক্ষুধাক্লিষ্টকে দায়ী করছেন। তাদের মতে, ক্ষুধার্ত মানুষ কেবল তাদের উৎপাদনশীলতাই হারায় না, ক্ষুধার্ত মায়ের গর্ভে জন্মে নেয়া শিশুটি অনিবার্যভাবেই কম ওজন, খর্বাকৃতিসহ নানা জটিল ও কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তাছাড়া ক্ষুধার্ত মা কখনোই তার শিশুকে প্রয়োজন মতো বুকের দুধ খাওয়াতে পারবে না। খাদ্য ও পুষ্টির অভাবে মা নিজেই রোগাক্রান্ত, দুর্বল হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সারা দেশে কমিউনিটি ও ফ্যাসিলিটি পর্যায়ে পুষ্টি সেবা কার্যক্রম বাস্তবায়নের নির্মিত্ব ‘ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিসেস (এনএসএস)’ শীর্ষক একটি অপারেশন প্ল্যান গ্রহণ করলেও এর সুফল অনেক মায়েদের কাছেই আজো পৌঁছেনি।
সরকারের দলিলপত্রে কোথাও ক্ষুধাক্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। অথচ খোদ রাজধানীর ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে, বাস টার্মিনালে, রেল স্টেশনে ও নৌ টার্মিনালসহ জনসমাগমস্থলে ক্ষুধার্ত মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেখা যায়। ভিক্ষুক ও অন্যান্য সাহায্য প্রার্থী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সামর্থবানরা ভিক্ষা কিংবা সাহায্য প্রদানে অনেকাংশে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। আয় ও সম্পদ বৈষম্য বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় প্রান্তিক ও বর্গাবাষীদের অনেককেই তিন বেলার জায়গায় সর্বোচ্চ দুই বেলা খেয়ে দিন গুজরান করতে হচ্ছে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর কয়েকজন গবেষক বলেছেন, তাদের একাধিক গবেষণায় কৃষকদের প্রণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ ও বিপন্ন দশায় পতিত হওয়ার বিষয়টি ওঠে এসেছে। তবে সরকারের নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তারা গবেষণায় ক্ষুধাক্লিষ্টতাকে উহ্য রেখে দারিদ্র্যকেই ফোকাস করে থাকেন।
দেশের আর্থ-সামাজিক খাতের সরকারি বার্ষিক দলিল বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩ এ ক্ষুধাক্লিষ্ট জনগোষ্ঠী আছে এমন কথা বলা না হলেও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দারিদ্র পরিমাপে জনপ্রতি প্রতিদিন ২১২২ কিলো ক্যাথরীয় নিচে খাদ্য গ্রহণ অনপেক্ষ দারিদ্র এবং ১৮০৫ কিলো ক্যালরীর নিচে খাদ্য গ্রহণকে চরম দারিদ্র্য হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে আয় দারিদ্র্যের হার ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে আসে। অপরদিকে ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আয় দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। সর্বশেষ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় আরো বলা হয়, জনসংখ্যার ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ ভূমিহীন, ৪৫ দশমিক ১ শতাংশের জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক ০৫ একরের নিচে, ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশের জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক ০৫ থেকে শূন্য দশমিক ৪৯ একর, ২৫ দশমিক ৩ শতাংশের শূন্য দশমিক ৫০ থেকে ১ দশমিক ৪৯ একর, ১৪ দশমিক ৪ শতাংশের ১ দশমিক ৪ থেকে ২ দশমিক ৪৯ একর, ১০ দশমিক ৮ শতাংশের ২ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক ৪৯ একর এবং ৮ শতাংশের জমির পরিমাণ ৭ দশমিক ৫ একর বা তার ঊর্ধ্বে। অর্র্থাৎ ভূমিহীন ও নগন্য পরিমাণ ভূমিকর অধিকারী জনসংখ্যার হার বেশি। এসব মানুষ প্রায়ই অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত থেকে দিন কাটায়। কিন্তু ওদের নিয়ে ভাষার সময় যেনো নীতিনির্ধারকদের নেই।
এদিকে দেশে দারিদ্র্যের হার কমে আসছে সরকার পরিসংখ্যান দিয়েই এমন দাবি করছে। দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও যারা প্রকৃতই ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠী তাদের কোনোই কাজে আসে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রশাসন বিভাগের সাম্প্্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, চলমান বিপুলসংখ্যক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির সুবিধাভোগী নির্বাচনে রাজনৈতিক বিবেচনা ও স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতির কারণে প্রকৃত অভাবী বা ক্ষুধার্ত মানুষগুলো বরাবরই এসব কর্মসূচির বাইরে থেকে যায়।