মিসরের গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে
আরব বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ মিসরে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সদ্যজাত গণতন্ত্র এখন আইসিইউতে চলে গেছে এবং লাইফ সাপোর্টে আছে। অথচ এই গণতন্ত্রের প্রতি নজিরবিহীন জনসমর্থন ছিল। এখন নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে এই কারণে যে, এর প্রভাব অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কয়েকটি চিহ্নিত মহল প্রেসিডেন্ট মুরসির তীব্র সমালোচনা করে থাকে। কারণ তিনি ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন সদস্য। তার গৃহীত পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা ও সমালোচনা করতো তারা। বিরোধী জোট ও মিডিয়ার ব্যাপক প্রচারণা, সাবেক স্বৈরশাসকের আমলের আমলাদের প্রভাব এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। আহরাম সেণ্টার ফর পলিটিক্যাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের বিশ্লেষক আবদুল কাদেরের মতে, মুরসি মিসরবাসীর প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। পর্দার অন্তরালে থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডই মূলত তার পেছনে কাজ করে সমগ্র দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। তারা জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও বিচার বিভাগের উপরও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে বলে অভিমত প্রকাশ করেন আবদুল কাদের। তিনি আরও বলেন, মুরসির অক্ষমতা ও শক্তিশালী নেতৃত্ব নৈপুণ্যের অভাব অনেকের মনেই এই ধারণার জন্ম দেয়। দীর্ঘ ৮০ বছর ধরে মুসলিম ব্রাদারহুড নির্যাতন নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে। বিপ্লবের পর তারাই মিসরের রাজনীতিতে সর্ববৃহৎ দল হিসাবে আবির্ভূত হয়। হোসনি মোবারককে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে তারা দৃঢ় ভূমিকা পালন করে। তবে বেশি দিন ক্ষমতা থাকার কারণে সংগঠনটি কিছু ভুল করে বসে। তাদের কিছুটা বাড়াবাড়ির কারণে ইসলামপন্থী থেকে শুরু করে বামপন্থী সকল গ্রুপ এই সংগঠনটির উপর ক্ষুব্ধ হয়। মুরসি সকল কিছুই নিজের হাতে পরিচালনা করার চেষ্টা করেন। বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা লোকজন রাস্তায় নেমে আসে। তবে বিরোধীরা ছিল দুর্বল ও অসংগঠিত। এ কারণে প্রথমদিকে রাস্তার আন্দোলনে তারা মুরসির পতন ঘটাতে সক্ষম হয়নি। তবে মধ্য এপ্রিলে তরুণরা তামান্দ বা বিদ্রোহ নাম দিয়ে যখন প্রতিবাদ বিক্ষোভে নামে তখন পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। তারা মুরসির পদত্যাগের দাবির পক্ষে কোটি লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে। তারা দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোর ও জনগণের সমর্থন লাভ করে।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে মুরসির ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম বর্ষপূর্তির দিন ৩০ জুন তার ক্ষমতার শেষ দিন বলে তারা ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন শুরু করলে ব্যাপকহারে লোকজন যোগ দেয়। এতো লোক তাদের সঙ্গে যোগ দেবে এটা তারা ধারণাই করতে পারেনি। প্রথমদিকে মুরসি ও ব্রাদারহুড এটাকে তেমন গুরুত্বই দেয়নি। ৩০ জুন দেখা যায় লাখ লাখ লোক জাতীয় পতাকা হাতে তরুণদের আন্দোলনে শরীক হয়েছে। স্কাইনিউজের আরবি বিভাগের সম্পাদক আহমদ আতার মতে, যারা রাস্তায় নেমে আসে তারা যতটা না মুরসি বিরোধী ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল ব্রাদারহুড বিরোধী। তবে সরকারপন্থী সাপ্তাহিক রোজ আল ইউসুফের উপ-সম্পাদক আশরাফ আবু রিশ যুক্তি তুলে ধরে বলেন, মুরসির আমলে দেশ মারাত্মক অচলাবস্থার মুখোমুখি হয় এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হয়। মানুষ তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দুষ্প্রাপ্যতার জন্য বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, মুরসি ও ব্রাদারহুড গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কিছু ভুল করে বসে।
বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও আমলাতন্ত্র ছিল মুরসির বিরোধী। এসব মহলের বিরোধিতা উপেক্ষা করে ব্রাদারহুড গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজেদের লোকদের বসাতে শুরু করে। ফলে সরকারি আমলাতন্ত্রের ক্ষমতাশালী অংশের সঙ্গে তারা সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। একদিকে যখন পরোক্ষ লড়াই চলছে ঠিক তখনই অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক সংকটে সমাজের নি¤œ শ্রেণীর মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এতে তারা মুরসি বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়ে। গরিবদের দেয় ভাতা ও অর্থনৈতিক সমর্থন প্রত্যাহার করা হচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লে তারা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
এক্ষেত্রে মিডিয়া মুরসির মর্যাদা ও ভাবমর্যাদা খাটো করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। টকশোগুলোতে মুরসিকে নিয়ে উপহাস করা হয়। এমনকি সরকারি অর্থে পরিচালিত টিভি ও সংবাদপত্রেও মুরসি বিরোধী ভূমিকা পালন শুরু করে।
আহমদ আতা বলেন, সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের পর বিপ্লব এখন পেছনের দিকে যাত্রা করেছে। আবদুল কাদের বলেন, অর্থনীতি ও শিক্ষার উন্নয়নে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি। অন্যথায় বিপ্লব সফল হবে না। আবু রিশ সামাজিক সংহতি ও দেশের সব মানুষের পুনর্মিলন ঘটানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, সামাজিক সংহতি জোরদার করা ছাড়া পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ব্রাদারহুডের নেতাদের গ্রেফতার দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক করে তুলবে বলে তিনি মনে করেন।