পশ্চিমা প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে মুসলিম সমাজকে
খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ:
প্রাচীনকালে সমগ্র পৃথিবীর সামাজিক অবস্থায় প্রভাব বিস্তার করেছিল মিসরীয় সংস্কৃতি। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক চিন্তাবিদ ও ঔপনিবেশিকদের কারণে সারা বিশ্বে গ্রিক সভ্যতা প্রাধান্য লাভে সক্ষম হয়। এরপর রোমীয় সাম্রাজ্য গ্রিক চিন্তাধারার গোড়ায় নিজেদের সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব বিস্তারে বড় মাপের সফলতা দেখিয়েছে। চৌদ্দশ’ বছর আগে ইসলাম যখন পৃথিবীর সভ্য সমাজে নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠায় কৃতিত্ব প্রদর্শন করল; তখন আরব-অনারবের বিভিন্ন সমাজ-সভ্যতার সমন্বয়ে ইসলামী সভ্যতার জন্ম হয়। যা বারোশ’ বছর পর্যন্ত পৃথিবীজুড়ে বিজয়ী সভ্যতার আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। এই সভ্যতার প্রধান চালিকা ছিল ইসলামের কালজয়ী শিক্ষা।
উপরোক্ত যুগ-পর্বে ঘটে যাওয়া বড় বড় পরিবর্তন ও সমাজ বিপ্লবের ধারায় দৃষ্টি ফেরালে দেখা যাবে, সাধারণত বিজিত সমাজের ওপর বিজয়ীদের প্রভাব ছিল ব্যাপক মাত্রায়। এরূপ বিজয়ের ফলে বিজিত জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, সাহিত্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবনধারা, সাংস্কৃতিক ধাঁচ-ধরন, যুদ্ধ ও শান্তিনীতি, নগর জীবনের কৃষ্টি—এক কথায় বিজিত জীবনের সব ক্ষেত্রে বিজয়ী সভ্যতার আধিপত্যের ছাপ স্পষ্ট। চার বছর পর্যন্ত বিস্তৃত রেনেসাঁ আন্দোলনের ফলে ইউরোপে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। নিজেদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বদৌলতে পশ্চিমারা মাত্র কয়েক শতকে গোটা পৃথিবীর ওপর নিজেদের বিজয় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়; যা এখনও পূর্ণ প্রতাপে বিদ্যমান। বৈজ্ঞানিক উত্কর্ষের বাইরে সাম্প্রতিককালে পশ্চিমা সংস্কৃতি পুরো দুনিয়ায় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আর্থ-সামাজিক ও চিন্তা-গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্ব সভ্যতাকে প্রভাবিত করে রেখেছে। যার নানা প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সর্বক্ষণ ও সর্বত্রই লক্ষণীয়।
‘পরিবর্তন’ একটি বিস্তৃত ও ব্যাপকতর ধারণা। একটি লেখায় এর সব ক’টি দিক পরিবেষ্টন করা মুশকিল। বর্তমান লেখাটি আমরা কেবলই মুসলমানদের সমাজে ঘটমান পরিবর্তন ধারায় সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। এই নিবন্ধে আমরা পর্যালোচনায় যাব একটি সমাজে নানামুখী পরির্বতনগুলো কীভাবে ঘটে সে বিষয়ে। একেকটি সমাজ অন্য সমাজের কাছ থেকে কীভাবে নতুন নতুন বিষয় শেখে? সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ধারণাটির প্রকৃতি কী? সমাজ কীভাবে নিজেদের মধ্যে নতুন বিষয়াদি সংযোজন করে এবং কীরূপে এক সময় তা নিজস্ব রীতি-নীতির অংশে পরিণত করে নেয়? সামনের আলোচনায় আমরা আধুনিককালে ঘটমান পরিবর্তনগুলোর স্বরূপ বুঝতে চেষ্টা করব। এসব পরিবর্তনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলোর বিশ্লেষণে মনোনিবেশ করব। আলোচনা হবে এসব পরিবর্তনের বিপক্ষে অনুসৃত কর্মকৌশলের নানা দিক নিয়েও। আধুনিক যুগে মুসলিম সমাজে সূচিত পরিবর্তন সম্বন্ধে গৃহীত পদক্ষেপ বিষয়েও আলোকপাত করা হবে। এ প্রসঙ্গে আমাদের কতিপয় প্রস্তাবনা পেশ করার ইচ্ছে থাকল।
সমাজ বদলে যাওয়ার বড় একটা উপলক্ষ শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রাগ্রসরতা
প্রতিটি সমাজে শিক্ষার সাধারণ কর্মসূচি চালু থাকে। একেকটি সমাজ বিশেষ কোনো বিষয়ে অন্যকে ছাড়িয়ে যায়। আবার অপরটি এগিয়ে থাকা সমাজকে পেছনে ফেলে দিতে পারে অন্য কোনো ক্ষেত্রে। সমাজের বিদ্বান ও প্রাজ্ঞ জনেরা প্রতিযোগিতামূলক অধ্যয়ন-গবেষণার মাধ্যমে উত্কৃষ্টের অনুসন্ধানে বিচরণ করতে থাকেন নিরন্তর। এই ধারাবাহিকতায় তারা অন্যের কাছ থেকে নতুন কিছু আয়ত্ত ও আত্মস্থ করে তার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের সমাজকে এগিয়ে নেন। এর চমত্কার দৃষ্টান্ত পশ্চিমাদের বিজ্ঞ শ্রেণী প্রাচ্যবিদরা (ঙত্রবহঃধষরংঃং)। এ শ্রেণীর স্কলার্সকে প্রাচ্য সমাজ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলা যায়। তারা প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও সমাজ থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করে তার কার্যকর প্রয়োগ ও ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের (পশ্চিমা ইহুদি-খ্রিস্টান ও সেক্যুলার সমাজ) সমাজ উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। জ্ঞান আহরণের কর্তব্যটি সাধরণত প্রতিটি সমাজের জ্ঞানীরাই সম্পাদন করে থাকেন। যারা নিজেদের অনুসন্ধান, গবেষণা ও অপরাপর সমাজ সম্পর্কে অধ্যয়নের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন-অগ্রগতি নিশ্চিত করতে তত্পর থাকেন। হিজরি সালের প্রথম কয়েক শতকে মুসলমানদের শিক্ষিত শ্রেণী রোম ও গ্রিক সভ্যতার কল্যাণকর জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করে তা আরবিতে অনুবাদের কাজ সম্পাদন করেছিলেন। এরপর কয়েক প্রজন্মের মুসলিম গবেষকরা সেই জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা, অধ্যয়ন ও গবেষণার মাধ্যমে তা আরও সমৃদ্ধ করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার ফলে পৃথিবীতে প্রায় ১২শ’ বছরের মতো মুসলমানদের অধিষ্ঠান ছিল পৃথিবীর পরাশক্তির আসনে।
এ দীর্ঘ সময়টিতে ইউরোপ অন্ধকার যুগ অতিক্রম করছিল। সমগ্র পৃথিবীতে তাদের পরিচিতি ছিল পশ্চাত্পদ জাতি হিসেবে। তারা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণে মনোনিবেশ এবং মুসলমান মনীষীদের রচিত গ্রন্থাবলি নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে নিজেদের সমাজকে আলোকিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং নিত্য-নতুন বিষয়ের জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগ করে, তখন সময়ের ব্যবধানে আগের চিত্র পাল্টে যায়। ইউরোপীয়রা পৃথিবীতে নেতৃত্বের আসনে উঠে আসে আর ক্রমেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। দুটি বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ তার বিরাট শক্তি ক্ষয় করে বসে। এরপর আমেরিকার উত্থানপর্ব; যা বস্তুত পাশ্চাত্য উত্থানের ধারাবাহিকতা মাত্র।
পশ্চিমাদের উন্নতির মূলে যে ব্যাপারটি ক্রিয়াশীল তা হলো, বস্তুকে শক্তিতে পরিণত করার এমন সব কৌশল উদ্ভাবন যার ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় বিপ্লব ঘটে যায়। গত দুই শতাব্দীতে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেলিগ্রাম, বৈদ্যুতিক বাতি, টেলিফোন, উড়োজাহাজ, মোটর গাড়ি, টেলিভিশন, মেডিসিন, চিকিত্সা যন্ত্র, কম্পিউটার, ইন্টারনেটের মতো অসংখ্য জিনিস তারা আবিষ্কার করে; যা মানুষের পুরো জীবনধারাই পাল্টে দিয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানের (ঝড়পরধষ ঝপরবহপবং) উত্কর্ষ সাধনে তারা অসামান্য অবদান রেখেছে। যার ফলে গণতন্ত্র, গণমুখী নেতৃত্ব (অথবা জনগণের ক্ষমতায়ন!) প্রভৃতি ধারণা পুরো দুনিয়ার সামনে চলে আসে।
বিগত ২০-২৫ বছর সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় পশ্চিমাদের উন্নতির ফলে পৃথিবীতে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রবাহের (ঈড়সসঁহরপধঃরড়হ) এমন সব প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয় যার ফলে পৃথিবী ছোট হতে হতে বিশ্বগ্রামে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সময়ে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোও বিশ্বমঞ্চে মর্যাদাপূর্ণ আসন অধিকার করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। বিগত ১৫-২০ বছরে চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতামূলক উন্নয়নের গতি পুরো দুনিয়াকে অবাক করে দিয়েছে। এর সবকিছুই শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রাগ্রসরতার ফসল।
একইভাবে সমাজ-সভ্যতার পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশে রাজনৈতিক কর্মসূচির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। পৃথিবীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন মুসলমানদের হাতে ছিল তখন অনুকূল পরিস্থিতির সুবাদে বিশ্ববাসী মুসলমানদের সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে অধ্যয়ন না করে উপায় ছিল না এবং সে অনুযায়ী নিজেদের জীবনে পরিবর্তন আনার সহজ সুযোগ ছিল। পাশ্চাত্যের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছে মুসলমানদের বেলায়। কাজেই যেখানে পশ্চিমারা মুসলিম জনপদে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানেই তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনাচার, শিক্ষা, চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেয়। এটি দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও একইভাবে অব্যাহত আছে। ফলে তাদের সমাজও ক্রমেই ওয়েস্টার্ন হতে চলেছে।
অপরাপর জাতি-গোষ্ঠীর রাজনৈতিক অবস্থাও নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হিসেবে কাজ করে। বিংশ শতাব্দীর কিছুকাল পূর্বাবধি ইউরোপীয়রা বিশ্বের পরাশক্তিরূপ ছিল। পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের ফলে সেই শক্তি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। সে জায়গাটি দখল করে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত তারা সারা বিশ্বের সমাজ-সভ্যতায় সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম ছিল। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই কর্তৃত্ব একচ্ছত্রভাবে আমেরিকার জন্যই হয়ে যায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইউরোপের প্রভাব-প্রতাপ যদিও এখনও তুঙ্গে কিন্তু আমেরিকার তুলনায় তা অনেকটাই ম্রিয়মাণ। এর কারণ বিশ্বজুড়ে আমেরিকার রাজনৈতিক আধিপত্য। হয়তো অল্পদিনের ব্যবধানে উদীয়মান চীন এ আসনটি দখলে নেবে, তবে এটি একচেটিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কব্জায়। কোনো জাতি যখন সামাজিকভাবে উন্নতির শিখরে আরোহণ করে তখন তার সঙ্গে জ্ঞানের সম্পর্কটারও উন্নতি ঘটে। সমাজে যুগশ্রেষ্ঠ গুণীজন আর কীর্তিমান ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়। যারা সমাজের শিক্ষা-দীক্ষার উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারে। দারিদ্র্যের বৃত্তে ঘূর্ণায়মান দুর্ভাগা জাতির ক্ষেত্রে এমনটি কদাচিত ঘটে থাকে। ধনী দেশগুলো গরিব রাষ্ট্রগুলোকে কেবল আর্থিক সাহায্য নয়, নিজেদের সম্পদ বাড়াতে বিনিয়োগ হিসেবে ঋণও দিয়ে থাকে। প্রথমে ধনী রাষ্ট্র থেকে এই পুঁজি গরিব দেশে স্থানান্তর হয়, কিন্তু যখনই ঋণগ্রহীতা দেশ প্রাপ্ত অর্থ খাটিয়ে বিনিয়োগকৃত প্রকল্প থেকে মুনাফা অর্জন শুরু করে—পুঁজি বিনিয়োগকারীরা তখন তার বিনিয়োগ বিশেষ প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে নেয়। ব্যস! মুনাফা সোজা বিনিয়োগকারী ধনী রাষ্ট্রে ফিরে আসে।
এসব ধনী রাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিনিয়োগের পুঁজির সঙ্গে নিজ দেশের কালচারও নিয়ে আসে ঋণগ্রহীতা গরিব দেশটিতে। অ্যাডভারটাইজিং প্রভৃতি কর্মপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এসব দেশে ওদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য ক্রমেই শেকড় বিস্তার করতে থাকে। যার ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত সমাজে নানা রকম পরিবর্তন দৃশ্যমান হতে শুরু করে। এর তাজা দৃষ্টান্ত হলো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর তত্পরতার ফলে আবহমান সমাজের পশ্চিমায়ন।
মুসলিম জ্ঞানী-গুণীজনদের চিন্তা, প্রজ্ঞা ও কর্মপন্থাগত চেষ্টা থাকতে হবে এ পশ্চিমায়ন থেকে বাঁচার, স্বকীয় আদর্শ ও ঐতিহ্য ধরে রাখার।