মৃত্যুদণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে বিদেশের জেলে ৩৫ বাংলাদেশী
সালমান ফরিদ: মৃত্যুদণ্ডের আদেশ মাথায় নিয়ে বিদেশের জেলে দিন কাটছে ৩৫ বাংলাদেশীর। জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তারা এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। যে কোন দিন তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। বিশ্বের ১০টি দেশের আদালত ইচ্ছাকৃত হত্যা, হত্যা প্রচেষ্টা এবং ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। তাদের মধ্যে মধ্যে জর্ডানে ২, সৌদি আরবে ৭, আবু ধাবিতে ২, বাহরাইনে ১, দুবাইয়ে ৮, কুয়েতে ১১, মালয়েশিয়ায় ৩, ওমানে ১, কাতারে ৩ এবং সিঙ্গাপুরে ১ জন রয়েছে। এছাড়া, ওইসব দেশসহ ১১টি দেশে একই অভিযোগে বিচারাধীন আছে আরও ৩৮ বাংলাদেশী। তাদের মধ্যে একাধিক অভিযুক্তের মামলার আদেশ এখন বাকি। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার মতো অপরাধ হওয়ায় তাদের বেশির ভাগের একই আদেশ হতে পারে। এর মধ্যে যারা মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পেয়েছে তাদের ১৭ জন নিজ দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশী প্রবাসীকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত। বাকিরা বিদেশী নাগরিককে হত্যা করেছে, না হয় হত্যায় সহায়তা করেছে। এদের মধ্যে মালয়েশিয়ায় অভিযুক্ত এক বাংলাদেশী একই পরিবারের ৭ জনকে হত্যার অভিযোগে ফাঁসির অপেক্ষায় আছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক অভিযুক্তের পক্ষে আইনি সহায়তা দেয়া হয়। বিদেশে অভিযুক্ত ব্যক্তির কোন স্বজন না থাকলে রাষ্ট্রই আদালতে লড়াই করে।
মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. জাফর আহমদ খান বলেন, রাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তদের আইনি সহায়তা দিচ্ছে। তাদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। হয়তো সবাইকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কিন্তু আমরা আশাবাদী, এদের মধ্যে অনেকের শাস্তি লঘু দণ্ডে নিয়ে আসতে পারবো।
তিনি জানান, নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করা হয়। সৌদি, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে শরিয়া আইনের কারণে কখনও কখনও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে মার্জনা নিয়ে আসা সম্ভব হয়। তবে তা সবার ক্ষেত্রে পারা যায় না। তিনি বলেন, যারা মার্জনা পান মৃত্যুদণ্ড থেকে তাদের রেহাই মেলে। কিন্তু আদালতের নির্দেশের আলোকে নির্দিষ্ট সময় জেল খাটতে হয়।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ড জানায়, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর পর পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে দূতাবাসের মাধ্যমে আইনি সহায়তা দেয়া হয়। তবে কখনও কখনও রাষ্ট্র নিজেই ওই দেশের আদালতের পত্র পেয়ে নাগরিকের সহায়তায় এগিয়ে যায়। তাদের পক্ষ থেকে নিহত পরিবারের কাছে দূতাবাসের মাধ্যমে ক্ষমা ও করুণা প্রার্থনা করা হয়। মানবাধিকার সংস্থাকেও এব্যাপারে সহায়তার জন্য অনুরোধ করা হয়। বর্তমানে যারা মৃত্যুদণ্ডের আদেশ নিয়ে দিন গুনছেন, তাদের বেলায় একই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। জর্ডানে অভিযুক্তদের ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য সেখানকার রাজার কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। অবশ্য নিজ দেশী নাগরিককে হত্যা করা বা এদের বিরুদ্ধে অপরাধের বেলায় রাষ্ট্র ক্ষমা প্রার্থনার পরিবর্তে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার অনুরোধ জানায় এবং অভিযুক্তকে আইনি সহায়তা দেয়। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বেশির ভাগ সময় অভিযুক্তরা অপরাধ স্বীকার করে নেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আদালত রায় দেন। এতে সাজা মার্জনা বা তাদের পক্ষে জোরালো কোন উদ্যোগ নিতে পারে না রাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরবে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দুবাইয়ে গুলি করে এবং অন্য দেশগুলো ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রায় বাস্তবায়ন করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এমুহূর্তে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পাওয়া বাংলাদেশী নাগরিকের সংখ্যা বেশি। জর্ডানে আছে বরিশাল উজিরপুরের কেশবকাঠীর হেমায়েত উদ্দিন, ঢাকার ধামরাইয়ের বোরাইক গ্রামের দেলোয়ার হোসাইন ফাঁসির দণ্ডাদেশ পেয়ে আছে জেলে আটক। সৌদি আরবে মৃত্যুর প্রহর গুনছে সিলেটের বিয়ানীবাজারের ঝুনাগ্রামের জয়নুদ্দীন, সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজারের কুলাউড়া গ্রামের রিয়াদুল হক, কুমিল্লার সাইদুর রহমান, চাঁদপুরের মতলবের ফরিদকান্দি গ্রামের জামাল উদ্দিন। জামাল উদ্দিনের সঙ্গে নিহতের পরিবার ২৩ লাখ সৌদি রিয়াল ব্লাডমানির বিনিময়ে সমঝোতা করতে আগ্রহী। মাদারীপুরের রাজৈর থানার গোপালগঞ্জের সোয়েব ব্যাপারী, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার বালুর চর গ্রামের লিটন। নরসিংদীর পলাশ থানার আসমানদির আবু বকর মিয়ার মৃত্যুদণ্ড লাঘবের জন্য নিহতের পরিবারের দাবি ৩০ লাখ সৌদি রিয়াল। টাঙ্গাইলের সরূপুর বোয়ালীর আলম উদ্দিন, মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার কাটরাসিন গ্রামের আব্দুস সালাম। এছাড়া হোসেন মিয়া, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের পূর্ব কামারগাঁওয়ের জব্বার খাঁ এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নিচিন্তা গ্রামের মো. নুরুদ্দীন রায়ের অপেক্ষায় আছেন। মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ করায় তাদের বিরুদ্ধে আদেশ মৃত্যুদণ্ড হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এদের মধ্যে হোসেন মিয়া পলাতক।
আবু ধাবিতে ফেনী জায়ারকাছার গ্রামের আবিদ উল্লাহ নুমান, দাগনভূঁইয়ার সাতিপুরের মোহাম্মদ শাহজাহান, বাহরাইনে কুমিল্লার তিতাসের কদমতলী গ্রামের রাসেল, দুবাইয়ে পাবনার আটঘরিয়ার মো. নায়েব আলী, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের চকপাগরা গ্রামের কামরুল ইসলাম, চৌদ্দগ্রামের আতিক আশরাফ, চট্টগ্রামের বহদ্দরহাটের কফিল উদ্দিন, আগ্রাবাদের দাইয়াপাড়ার হারুনুর রশিদ, ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার গ্রামের সাহাব উদ্দিন, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের যাত্রাপুরের সোহাগ, কুয়েতে জামারপুরের দেওয়ানগঞ্জের চরভবশুরের আবদুল আলিম, মাগুরার আলুকাদিয়ার বাগবাড়ের তবিবুর বিশ্বাস, বি-বাড়িয়ার নবীনগরের ধরাভাঙ্গার মকবুল, রাজাহা’র রিনু মিয়া, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের বাগবাড়ি গ্রামের ইকবাল হোসেন ও হৃদয়, কুমিল্লার হোমনার রমজান, ঢাকার কদমতলীর মো. শাহ আলম, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের মাইজেরমোল্লার তোজাম্মেল হোসেন এবং চুনারুঘাটের চিলুকোটের মাসুক মিয়া। মালয়েশিয়ায় পাবনার ঈশ্বরদীর পশ্চিমপাড়ার শামীম রেজা, গোপালগঞ্জের মোকাছেরপুর ছাগলছিরার ওলিয়ার শেখ ছাড়াও মো. মাসুদ রানা মালয়েশিয়ান একই পরিবারের ৭ জনকে হত্যা করে দণ্ড পেয়েছেন। ওমানে ইসকান্দার এবং সিঙ্গাপুরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের ভানয়া গ্রামের কামরুল হাসান এখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় রয়েছেন কারাগারে।