তফসিল ঘোষণা : ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন

ECদশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহম্মদ। তফসিল অনুযায়ী ২ ডিসেম্বর রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নিকট মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ। ৫ ও ৬ ডিসেম্বর মনোনয়পত্র বাছাই, ১৩ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ও ৫ জানুয়ারি ভোট গ্রহন করা হবে।
সোমবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ তফসিল ঘোষণা করেন। ভাষণে কাজী রকিব উদ্দিন আহম্মদ বলেন, দেশের সব মানুষের প্রত্যাশা শান্তি বজায় রেখে দেশকে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে দাঁড় করাতে সব রাজনৈতিক দল এগিয়ে আসবে।  এবং একটা রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সকলের অংশ গ্রহণে একটা সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণ তাদের রায়ের প্রতিফলন দেখতে পাবেন। এজন্য সকল রাজনৈতিক দলের কাছে বার বার অনুরোধ জানিয়েছি তারা যেন জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে সমঝোতায় আসেন।
রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ এর কথা উল্লেখ করে সিইসি বলেন, গত ১৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করেও আমরা তাঁকে অনুরোধ জানাই তিনি যেন বিশেষ উদ্যোগ নেন এই অসহনীয় অচলাবস্থা দূরকরতে। আমরা এখনও আশা রাখি জনগণের এ প্রত্যাশা উপেক্ষা করবেন না কেউই। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা।
বিলম্ব করার মতো সময় আর নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সংবিধান সমুন্নত রাখার জন্য শপথ নিয়েছি। সংবিধান মোতাবেক ২৪ জানুয়ারী ২০১৪ সালের মধ্যেই নির্বাচন করার বাধ্য বাধকতা রয়েছে। এতদিন আমরা অপেক্ষা করেছিলাম একটা রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য। আমাদের হাতে বিলম্ব করার মতো সময় আর নেই। তাই আজ দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছি। একই সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সকলের অংশগ্রহণে একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথে আসার সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি।
সিইসি বলেন, সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির শুরুতেই আমরা নির্বাচনের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের সাথে মত বিনিময় করি। সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহীগণ, নির্বাচনের সাথে সম্পৃক্ত এনজিও প্রধানদের সাথে আমরা পৃথক পৃথক বৈঠকে সকল বিষয়ে আলোচনা করি। নির্বাচনের প্রধান স্টেক হোল্ডার নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলির সাথেও পৃথক পৃথক ভাবে মত বিনিময় করি। ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ ও জাতীয় সংসদ আসনের সীমানা নির্ধারণ ছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও মতামত আহ্বান করা হয়।
তিনি বলেন, দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর বলেছিলাম আমরা আমাদের কাজের মাধ্যমে আমাদের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দেবো। জাতীয় সংসদের শূন্য আসনে ৭ টি এবং সিটি কর্পোরেশনের বড় বড় ৬ টি সহ এ পর্য্যন্ত আমরা ৬৫৪ টি নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছি। দেশী বিদেশী পর্যবেক্ষক, সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা এ সব নির্বাচনকে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ বলে আখ্যায়িত করেছেন। রাজনৈতিক দল এবং জনগণও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এগুলির উল্লেখযোগ্য অংশে বিরোধী দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জয়লাভ করে প্রমাণ করেছেন যে নির্বাচনগুলি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল। দেশী বিদেশী পযবেক্ষকগণ ও সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরাও অনুরূপ মতামত প্রকাশ করেছেন।
কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচনি ফলাফলকে ঘিরে বিভ্রান্তি নিরসন ও রাজনৈতিক দলের আস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্বাচনি আইনের বিধান অনুসারে আগামী নির্বাচনে প্রত্যেক কেন্দ্রে ভোট গণনার পর প্রিজাইডিং অফিসার প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের ফলাফল অতীতের মত শুধু অংকে লিখবেন না, কথায়ও লিখবেন। প্রিজাইডিং অফিসার ভোট কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা করার পর এজেন্টদের স্বাক্ষরকৃত রেজাল্টসীট রিটার্নিং অফিসারের কাছে প্রেরণ করবেন এবং তার একটি কপি ডাকযোগে সরাসরি নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। যত রাতই হোক না কেন ভোট কেন্দ্র থেকে রেজাল্টশীট জমা না হওয়া পর্যন্ত ডাকঘর খোলা রাখা হবে। আশা করি এ পদক্ষেপ ভোটের ফলাফল প্রকাশকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ করে তুলবে।
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ প্রসংগে তিনি বলেন, সংবিধানে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে প্রদান করা হয়েছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য স্টেক হোল্ডারদের মতামতকে যতদুর সম্ভব আমলে নিয়ে Delimitation of Constituencies Ordinance,১৯৭৬ এর সংশ্লিষ্ট ধারা মোতাবেক জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের পুনর্নির্দ্ধারিত সীমানা সংক্রান্ত খসড়া ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ তারিখের গেজেটে প্রকাশ করা হয় এবং ঐ খসড়ার উপর আপত্তি মতামত আহ্বান করে এক মাসের অধিককাল সময় দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারী করা হয়। জন সাধারণের জন্য উন্মুক্ত শুনানিতে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী অথবা তার পক্ষে নিযুক্ত এডভোকেটের যুক্তিতকর্, আপত্তি, মতামত বিবেচনা করে সীমানা নির্ধারণ চূড়ান্ত করা হয় এবং তা ৩ জুলাই ২০১৩ তারিখের গেজেটে প্রকাশ করা হয়। Representation of the People Order,১৯৭২ সহ অন্যান্য কয়েকটি আইন ও বিধিমালায়ও প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে।
নির্বাচন আচরণবিধি প্রসংগে তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন আচরণবিধিটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে করা ছিল। যেখানে উপদেষ্টাগণের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ ছিলনা। বর্তমানে দুইটি প্রধান রাজনৈতিক জোটের মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে মতানৈক্যের ফলে এখন পর্য্যন্ত এ বিষয়ে কোন সমঝোতা হয় নি। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলের নেতা, মন্ত্রী ও অন্যান্য সরকারী সুবিধাভোগী বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিবর্গকে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে কিছু কিছু নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনে সকলের জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুতের নিমিত্তে আচরণবিধিতে কিছু সংশোধন আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, ভারত, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ বেশ কিছু সংসদীয় গণতন্ত্র অনুসরণকারী দেশের নির্বাচন আচরণবিধির আলোকে আমাদের আচরণ বিধিতে কয়েকটি সংশোধন আনা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর খসড়া সহ ২০০৮ সালের আচরণবিধি কমিশনের ওয়েব সাইটে গত ৩ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে প্রকাশ করে এক সপ্তাহ ধরে এর উপর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ সকল মহলের মতামত আহ্বান করা হয়। বেশ কিছু মতামত পাওয়া যায় তার মধ্যে থেকে কয়েকটি মতামত গ্রহণ করে চূড়ান্ত আচরণবিধি জারী করা হয়েছে। কমিশনের ওয়েব সাইটে তা পাওয়া যাবে।
সিইসি বলেন, সংশোধিত আচরণবিধিতে তফসিল ঘোষণার দিন থেকে নির্বাচন পূর্ব সময় শুরু হবে এবং নির্বাচনের ফলাফল গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হওয়া পর্য্যন্ত তা বলবৎ থাকবে। এতে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলের নেতা, মন্ত্রীবর্গ এবং সরকারি সুবিধাভোগী অন্যান্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন থেকে সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা করতে পারবেন না। তবে প্রাপ্যতা অনুযায়ী তারা নিরাপত্তা পাবেন। সংসদ সদস্যগণ বা তাদের কোন প্রতিনিধিরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্বে থাকলে নির্বাচন পূর্ব সময়ে ঐ কমিটির কোন সভায় যোগ দিতে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না।
তিনি বলেন, তারা তাদের ইচ্ছাধীন তহবিল বা তাদের অধীনস্থ অন্য কোন তহবিল থেকে কোন অর্থ কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করতে পারবেন না। তারা নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি সুযোগ সুবিধাসহ সরকারি যানবাহন সরকারি কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের ব্যবহার করতে পারবেন না। এ ছাড়াও পূর্বের সকল বিধি নিষেধ ও বলবৎ থাকবে।
আচরণ বিধি প্রসংগে তিনি বলেন, নির্বাচন আচরণ বিধি প্রয়োগে কোন ছাড় দেওয়া হবে না। কে কোন পদে আছেন তা দেখা হবে না। তিনি কোন্‌ আচরণ বিধি ভঙ্গ করলেন শুধু সেটাই দেখা হবে এবং সে মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।যে কোন নির্বাচনের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের আচরণের উপর। নির্বাচনী আইন ও আচরণ বিধিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বিভিন্ন রঙের পোস্টার ব্যবহার বা দেয়ালে সাঁটানো, দেয়াল লিখন, গেইট বা তোরণ নির্মাণ, বৈদ্যুতিক আলোকসজ্জা ইত্যাদির উপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে তা আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল প্রার্থী গণতনের মলমনে উজ্জীবিত হয়ে এগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করবেন এবং পরসঙরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে শানিপর্ণ পরিবেশ বজায় রাখবেন।
তিনি বলেন, নির্বাচন-পর্ব সময়ে মিছিল সহকারে শো-ডাউন, আপ্যায়ন ও ভোট কেনা বেচার বিরুদ্ধে সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। বিশেষ করে মনোনয়নপত্র জমা প্রদানকালে চিরাচরিত শো-ডাউন কোনভাবেই বরদাশত করা হবে না এবং আচরণ বিধির এ জাতীয় লংঘন করা হলে তা ঐ প্রার্থীর প্রার্থিতা অনিশ্চিত করতে পারে। এবার প্রতি জেলায় শক্তিশালী মনিটরিং টিম নিয়োগ করা হয়েছে যারা প্রতিনিয়ত আচরণবিধি লঘনের ঘটনা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
প্রিধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, একই দিনে সারা দেশে ৩০০ সংসদীয় আসনে আমাদের নির্বাচন করতে হয়। উপরন্তু আমাদের এ জনবহুল দেশে ভোটার সংখ্যাও বিশাল। এ বিরাট কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সমঙন্ন করতে শানি শৃখলা রক্ষা করা অতি দুরূহ। তাই প্রতিবারের মতো এবারও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে,ভিডিপি,আনসার,পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর সাথে সকলের প্রিয় ও আস্থাভাজন সশস বাহিনীকেও নির্বাচনের জন্য দেশব্যাপী মোতায়েন করার সিদ্ধান আমরা গ্রহণ করেছি।
নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রসংগে তিনি বলেন, বিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য তারিখ বিবেচনায় নিয়ে আমরা ইতোমধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি সমঙন্ন করেছি। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম নির্বাচন কালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একটা সমঝোতায় আসবে সে আশায়। আগামী ২৪ জানুয়ারী ২০১৪ তারিখের মধ্যে এই নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় আমাদের পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button