জাকার্তায় তৃতীয় আন্তর্জাতিক ইসলামি মিডিয়া সম্মেলন অনুষ্ঠিত
জাকার্তা থেকে মাসুমুর রহমান খলিলী
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় আন্তর্জাতিক ইসলামি মিডিয়া সম্মেলনে মুসলিম দেশগুলোর গণমাধ্যমকে পুনর্গঠন করে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ করে তোলা এবং তাদেরকে যথাসম্ভব আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। সম্মেলনে ইসলামের প্রতি পশ্চিমের বৈরী শীর্ষ মিডিয়াগুলোর একপেশে প্রচারণার বিপরীতে অভিন্নভাবে অগ্রসর হতে একটি কৌশলগত ইসলামিক মিডিয়া সেন্টার স্থাপনেরও সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে মুসলিম বিশ্ব যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তা থেকে উত্তরণে এসব গণমাধ্যম সমন্বিতভাবে প্রচেষ্টা চালাতে পারে।
ইন্দোনেশিয়ার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক অর্গানাইজেশন অব মিডিয়া (আইআইওওএম) জাকার্তার হোটেল সাংগ্রিলায় এই তৃতীয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সম্মেলনের আয়োজন করেছে। গতকাল বুধবার সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে দু’টি কর্মঅধিবেশনের প্রথমটিতে আলোচনার বিষয় ছিল গণমাধ্যম ও সমাজের আন্তঃসম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সৌদি আরবের সংস্কৃতি ও তথ্য বিষয়ক উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আর জাসের। এ অধিবেশনে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির গণমাধ্যম বিভাগের অধ্যাপিকা নাসিয়া বাহফেন, শ্রীলঙ্কার আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ও কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রাশিদ মোহাম্মদ ফারুক, ইন্দোনেশিয়ার রিপাবলিকা মিডিয়া গ্রুপের প্রধান এরিক থোহির প্রমুখ। জাকার্তার শরীফ হেদায়েতুল্লাহ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগের চেয়ারমান অধ্যাপক মোহাম্মদ জুহদি সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন। অধিবেশন শেষে সম্মেলনের আলোচনা সম্পর্কে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করা হয়।
সৌদি মন্ত্রী মিডিয়ার সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন তত্ত্বের ওপর আলোকপাত করে বলেন, আজ পশ্চিমা দেশগুলোতে যে দায়বদ্ধতার কথা বলা হচ্ছে সে ব্যাপারে পবিত্র কুরআনেই সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছ্।ে এই নির্দেশনা অনুযায়ী সমাজ বা রাষ্ট্রে যা ঘটবে তা বিকৃতিহীনভাবে জনগণকে জানাতে হবে। সমাজের জন্য যা কিছু কল্যাণকর তা প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বিভিন্ন মুসলিম দেশের গণমাধ্যমের ওপর আলোকপাত করে বলেন, ইসলামি দেশগুলোতে অনেক গণমাধ্যমকে বাজার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতে দেখা যায়। সামাজিক স্বার্থ-বিবেচনায় না রেখে শুধু বাজার গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করলে তা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ জন্য আমেরিকার মতো দেশেও কর্তৃপক্ষের কাছে দেয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে স্থানীয় সমাজের জন্য কী ভূমিকা গণমাধ্যমটি রাখছে তা জানাতে হয়।
আবদুল্লাহ জাসের বলেন, মুসলিম দেশগুলোয় গণমাধ্যমে বিনিয়োগের ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের বিশেষভাবে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন, যাতে মুসলিম সমাজ যে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তা মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোয় গণমাধ্যম কৌশলের নতুন করে বিন্যাসের ওপরও তিনি গুরুত্ব দেন।
অধ্যাপিকা নাসেয়া বাহফেন তার গবেষণা নিবন্ধে দেখিয়েছেন, আধুনিক মিডিয়া কিভাবে মুসলিম তরুণ-তরুণীদের ওপর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রভাব ফেলছে। সামাজিক গণমাধ্যমগুলো ট্রয়ের ঘোড়ার মতো সমাজ ও পরিবারের একেবারে ভেতরে ঢুকে নৈতিক মূল্যবোধ ও শালীন রীতিনীতিতে আঘাত করছে। আবার এটি তথ্য জগতে অবাধ প্রবেশেরও সুযোগ সৃষ্টি করছে। টুইটার ও ফেসবুকের মতো সামাজিক গণমাধ্যম ইসলামের মূলধারার বিপরীত অতি গোড়া কিছু ধারণার বিস্তার ঘটাচ্ছে যার কারণে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে।
অধ্যাপক রাশিদ মোহাম্মদ ফারুক সমাজ উন্নয়নে ইসলামি গণমাধ্যম পুনর্গঠনে কী ধরনের ফোকাস, কৌশল ও কার্যক্রম নেয়া উচিত তার ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ প্রভাবিত গণমাধ্যমের প্রচারণার বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত রাখতে মুসলিম বিশ্বে বিশেষ সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়ার প্রতিনিধিত্বের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া সেন্টার স্থাপনের প্রস্তাব করেন। তিনি একই সাথে ইসলামি দেশের গণমাধ্যমগুলোকে গতিশীল, কার্যকর ও সক্রিয়তাবাদী করে পশ্চিমা মিডিয়ার বৈরী চ্যালেঞ্জের মোকাবেলার উপযোগী করে তোলার আহ্বান জানান। ইসলামী দেশগুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞান ও চিন্তা বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে একটি ইসলামিক মিডিয়া থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠারও সুপারিশ করেন তিনি।
রিপাবলিকা গ্রুপের প্রধান ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম মিডিয়া উদ্যোক্তা এরিক তোহির সুনৈতিকতা, সুশিক্ষা ও বিশ্বাসযোগ্যতার মৌলনীতির ওপর ভিত্তি করে তার গ্রুপভুক্ত বিভিন্ন গণমাধ্যম কিভাবে অর্থনৈতিক সাফল্য লাভ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাÑ দুটোই পুরণের চেষ্টা করছে তা তুলে ধরেন।
সম্মেলনে দিনের দ্বিতীয় কর্ম অধিবেশনের মূল বিষয় ছিল ‘মুসলিম সমাজে গণমাধ্যম:সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ।’ এই অধিবেশনে আলোচনায় অংশ নেন, ইন্দোনেশিয়ার সিনিয়র সাংবাদিক পারনি হাদি, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন ইলিনয়ের গণমাধ্যম বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এ সিদ্দিকী, তুরস্কের সালাম ওয়ার্ল্ডের সিইও আহমদ আজিমব, পাকিস্তানের গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ সৈয়দ রেহান হাসান, ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইজিপ্টের গণমাধ্যম বিভাগের অধ্যাপিকা আমানি বাসিউনি ও পিটি ফরচুনের ইন্দিরা আবিদিন। বিশ্বের ৪০টি দেশের চার শতাধিক মিডিয়া প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।