কাদের মোল্লার আপিলের রায় যে কোন দিন
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার সাজার বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি শেষ হয়েছে। আদালত যে কোন দিন রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন। প্রসিকিউশন পক্ষে এটর্নি জেনারেলের সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে শুনানি শেষে আপিল বিভাগ এই দিন ধার্য করেছেন। রায় ঘোষণার আগেরদিন আপিলটি কার্যতালিকায় আসবে। আগেরদিন ডিফেন্সের প্রধান কৌঁসুলি ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক শুনানি শেষ করেছিলেন।
গতকাল মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এর মধ্য দিয়ে আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হচ্ছে। আপিল বিভাগের বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন-বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সমাপনী বক্তব্য শুরু করেন। নয়টা ৫০ মিনিটে তার বক্তব্য শেষ হয়। এরপর আদালত বলেন, রায়টি অপেক্ষমাণ রাখা হলো।
গত ৩ মার্চ প্রসিকিউশন এবং পরদিন ডিফেন্সপক্ষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। গত ১ এপ্রিল আপিলের শুনানি শুরু হয়। প্রায় ৩৯ কার্য দিবস এ আপিলের ওপর শুনানি হয়েছে। তিন মাস ২৩ দিনের মাথায় এখন রায় ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে আপিলটি।
শুনানিতে প্রসিকিউশন পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এম কে রহমান, মুরাদ রেজা, মমতাজউদ্দিন ফকির ও ডেপুটি এটর্নি জেনারেল একরামুল হক প্রমুখ।
আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। তার সঙ্গে ছিলেন এডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, এডভোকেট তাজুল ইসলাম, এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, এডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির প্রমুখ।
আদালত থেকে বেরিয়ে এটর্র্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আপিলে ৩৯ কার্যদিবস শুনানি হয়েছে। আজ (মঙ্গলবার) আদালত শুনানি শেষে দুটি আপিল আবেদন সিএভি (রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ) রেখেছেন। রায় ঘোষণার আগের দিন মামলাটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসবে।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আপিলে সমান সুযোগ দিয়ে আনা সংশোধনীকে কাদের মোল্লর ক্ষেত্রে অকার্যকর বলেছেন আসামীপক্ষ। তারা বলছেন, এতে আসামীর অধিকার খর্ব করা হয়েছে। আমরা বলেছি, এতে আসামীর অধিকার খর্ব করা হয়নি। রাষ্ট্রেরও আপিল করার অধিকার রয়েছে। এটা সমতা আনার জন্য করা হয়েছে। এতে আসামীর সংক্ষুব্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, এ আইনের বিষয়ে সংবিধানে সুরক্ষা দেয়া আছে। এটা বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এটা চ্যালেঞ্জযোগ্য নয়।
প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাপারে তিনি বলেন, সার্বভৌম দেশ হিসেবে আমাদের দেশীয় আইনই প্রযোজ্য হবে। সাজার বিষয়ে তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালে ১, ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়নি। কেন মৃত্যুদ- দেয়া হয়নি রায়ে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। আমাদের আপিল মঞ্জুর হওয়া উচিত।
এর আগে সকালে শুনানিতে এটর্নি জেনারেল বলেন, অপরাধের উপযুক্ত সাজা না হলে ন্যায় বিচার থাকে না। আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।
প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন এ এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কারণ ১৯৭৩ সালের ট্রাইব্যুনাল আইন আমাদের দেশীয় আইন। আমাদের আইনে অপরাধের সংজ্ঞা দেয়া রয়েছে। সার্বভৌম দেশ হিসেবে দেশীয় আইনই প্রযোজ্য হবে। তিনি বলেন কাদের মোল্লা অপরাধ করেননি ডিফেন্স এ বিষয়ে প্রমাণ দেখাতে পারেনি। তাই আমাদের ( প্রসিকিউশন) আপিল মঞ্জুর হওয়া উচিত।
আগেরদিন ডিফেন্সের সমাপনী বক্তব্যে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক শুনানিতে বলেছিলেন, আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছেন ৫ ফেব্রুয়ারি। আর সরকারকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ দিয়ে আইন সংশোধন করা হয়েছে ১৮ ফেব্রুয়ারি। যেদিন ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছেন ওইদিন পর্যন্ত কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের এখতিয়ার ছিল না। সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারের আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করায় কাদের মোল্লার অধিকার ক্ষুণœ হয়েছে। আপিল প্রযোজ্য হতো যদি সংশোধনীতে স্পষ্ট করা হতো আইনে যাই থাকুক না কেন সংশোধনী কার্য়কর হবে। কিন্তু তা বলা হয়নি।
শুনানিতে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ভারত ও বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এবং যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালতের কয়েকটি নজীর তুলে ধরে বলেন, এ সংশোধিত আইনে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষীদের বক্তব্যের স্ববিরোধিতা ও অসামঞ্জস্যতার বিষয়টিকে এটর্নি জেনারেল শুনানিতে সূক্ষ্ম ও ক্ষুদ্র ভুল বলে যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। এর জবাবে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, এই অসামঞ্জস্যতা মোটেই সূক্ষ্ম নয়। মোটাদাগের ভুল।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ফৌজদারী কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য নয় বলে এটর্নি জেনারেলের যুক্তির বিরোধীতা করে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক শুনানিতে বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের বিধিমালার ৫৩ (২) ধারা মোতাবেক অসামঞ্জস্যতা আমলে নেয়ার বিধান রয়েছে।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, প্রসিকিউশন যে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন সেসব সাক্ষ্য প্রমাণ দুর্বল এবং নির্ভরযোগ্য নয়। এর ভিত্তিতে কাদের মোল্লাকে সাজা দেয়া অসম্ভব। আমরা মনে করি কাদের মোল্লার আপিল আদালতে গৃহীত হবে। কাদের মোল্লা বেকসুর খালাস পাবেন।
প্রসঙ্গত গত ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে দুটিতে তাকে যাবজ্জীবন, তিনটিতে ১৫ বছর করে কারাদ- এবং একটিতে খালাস দেয়া হয়। এ রায়ের প্রতিবাদে শাহবাগে শুরু হয় আন্দোলন। মূল আইনে সাজা বাড়াতে সরকার পক্ষের আপিলের বিধান না থাকলেও আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধন করে সরকার আপিলের সুযোগ লাভ করে। আইন অনুযায়ী রায়ের ৩০ দিনের মধ্যে আপিলের বিধান রয়েছে। সে হিসেবে গত ৩ মার্চ প্রসিকিউশন তথা সরকার সাজা বাড়াতে আপিল করে। পরদিন ৪ মার্চ আপিল করে ডিফেন্সপক্ষ। একমাস পর ১ এপ্রিল আপিলের ওপর শুনানি শুরু করে। সবমিলিয়ে আপিলে ৩৯ কার্যদিবসে শুনানি শেষ হলো। শুনানির মাঝে ছয় বিচারপতির বেঞ্চের সদস্য বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া গত ৩০ মে অবসরে যান। সে থেকে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি চলছে। গত ২০ জুন সাত জন এমিকাস কিউরি নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ। এ আপিলের শুনানিকালে উত্থাপিত আইনি প্রশ্নের মীমাংসায় তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ এর ক্ষেত্রে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে কি না? দ্বিতীয়ত, ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধন করে ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে যে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা (রেট্রোস্পেক্টিভ ইফেক্ট) দেয়া হয়েছে, তা কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না?
শুনানিতে অংশ নিয়ে আইনের সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলে মত দেন সংখ্যাগরিষ্ঠ এমিকাস কিউরি। এমিকাস কিউরিদের মধ্যে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ এবং ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি মত দেন যে, আইনের সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অন্যদিকে, সাবেক বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টি এইচ খান ও সাবেক এটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফের মতে সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ প্রশ্নে শুধুমাত্র ব্যারিস্টার রফিক-উল হক মত দেন তা প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের পক্ষে মত দেন। ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ১৯৭৩ সালের ট্রাইব্যুনালস আইনে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিফলন রয়েছে। মাহমুদুল ইসলাম বলেন, এ প্রশ্নে হ্যাঁ না উত্তর দেয়া কঠিন। সাধারণভাবে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে না। তবে দেশীয় আইনে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা থাকলে, শূন্যতা থাকলে অথবা ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজন হলে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। আজমালুল হোসেন কিউসি মত দেন, সাংঘর্ষিক না হলে আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন প্রযোজ্য হবে। টি এইচ খানের মত, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে। তবে দেশীয় আইনের সাথে আন্তর্জাতিক আইন সাংঘর্ষিক হলে সেক্ষেত্রে দেশীয় আইন প্রাধান্য পাবে। এ এফ হাসান আরিফের মতে আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন প্রযোজ্য হবে।