রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
ফরহাদ মজহার:
এক
ডক্টর কামাল হোসেন, শুধু গণতন্ত্রে আর সন্তুষ্ট নন, তিনি ‘কার্যকর গণতন্ত্র’ চান (দেখুন,‘Quest for a working democracy: Consensus on neutral election period government’, ডেইলি স্টার ৬ ডিসেম্বর ২০১৩; একই নিবন্ধের অনুবাদ দেখুন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার ঐকমত্যের সন্ধানে’, দৈনিক প্রথম আলো, ৬ ডিসেম্বর ২০১৩। তিনি আইনজীবী। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার চূড়ান্ত দলীয়করণ ঘটেছে, তার পরও তিনি বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে তোলার জন্য একটা সমঝোতা চান। সেই পথ হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা। এর জন্য সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হতে চান বলে তাঁর সাম্প্রতিক কথাবার্তায় মনে হয়েছে।
আদালতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছে, সেই রায়ের অজুহাতে পঞ্চদশ সংশোধনী দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা একদমই বাতিল করা আদালতের রায়ের সঙ্গে সঙ্গতপূর্ণ নয়। দশম সংসদ (২০১৪ সালে অনুষ্ঠেয়) এবং একাদশ সংসদের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এটা প্রমাণ করতে হলে আদালতেরই শরণাপন্ন হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘নিরপে’ ভাবে আদালতের ভূমিকা প্রত্যাশা করার অর্থ আদালতের বাইরে আরো কিছু রাজনৈতিক শর্ত পূরণ করতে সমর্থ হওয়া। বিশেষত আইন ও আদালতের বাইরে বলপ্রয়োগের ক্ষমতার ক্ষেত্রগুলোর বর্তমান ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটানো। কথায় বলে, সেটাই আইন যা বলবৎযোগ্য। বলপ্রয়োগের সঙ্গে আইনের সম্পর্ক রাজনীতি ও বিচারশাস্ত্র উভয়েই আজকাল স্বীকার করে। তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে, এবং তাকে বলবৎ করতে হলে মতার দরকার। সে ক্ষেত্রে চলমান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মতার সমর্থন দরকার হবে, অথবা সেনাবাহিনীর। কিন্তু বিরোধী পক্ষের আন্দোলন রাজনীতির নির্ধারক শক্তি হয়ে উঠেছে কি না সেটা তর্কের বিষয়। অতএব সেনাবাহিনীর প্রত্য না হোক পরো সমর্থন ছাড়া আদালতকে রাজনৈতিক সমঝোতার উপায় হিসাবে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। এই দিক থেকে আমরা মতাসীনদের প্রতি ডক্টর কামাল হোসেনের ছুড়ে দেওয়া সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষণ হিসাবেই দেখছি। ফলে এ বিষয়ে আলোচনা জরুরি।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র কাজ করছে না, এটা নতুন কথা নয়। তাহলে উচিত কাজ হচ্ছে কাজ না করবার কারণ খুঁজে বের করা। তিনি সেই দিকে যান নি। এই ক্ষেত্রে আমি দীর্ঘ দিন ধরে বলছি গণতন্ত্র ‘কাজ’ করা তো দূরের কথা, বাংলাদেশে রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট ধরণ হিসাবে ‘গণতন্ত্র’ কখনই কায়েম হয় নি। আগ্রহী পাঠক এ বিষয়ে ভিন্ন সময়ে আমার লেখালিখি থেকে ধারণা পাবার জন্য ‘গণতন্ত্র ও সংবিধান’ বইটির পাতা উল্টিয়ে দেখতে পারেন। এখানে সংক্ষেপ থাকার জন্য পুরানা তর্কের পুনরাবৃত্তি করব না। সত্য হচ্ছে ১৯৭২ সালে ডক্টর কামাল হোসেন যে ‘সংবিধান’ প্রণয়ন করেছেন বলে বলা হয় তার মধ্য দিয়েও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে কায়েম হয় নি। তা ছাড়া খোদ সংবিধান প্রণয়নপ্রক্রিয়ার মধ্যেই গলদ ছিল, নইলে কেউ বলত না একজন ব্যক্তি তা প্রণয়ন করেছে।
সেই তর্কেও আমরা এখন যাবো না। কথা হচ্ছে, নানান সময়ের সংশোধনী পার হয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর রাষ্ট্রের যে চরিত্র দাঁড়িয়েছে সে বোঝা বহন করে চলা এখন অসম্ভব। তাকে আর যা-ই হোক হোক গণতন্ত্র বলা চলে না। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান বা গণতান্ত্রিক ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন ও নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠন করা ছাড়া বাংলাদেশের পে এগিয়ে যাওয়া দূরে থাকুক, টিকে থাকা সম্ভব কি না সন্দেহ। তাহলে গোড়ার কাজেই আমাদের মনোনিবেশের দরকার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে অনুপস্থিত সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ‘কার্যকর’ হোল কি হোল না সেটা নিরর্থক তর্ক। তবে ডক্টর কামাল হোসেন বাংলাদেশের রাজনীতির দ্বন্দ্ব-সংঘাতে উত্তপ্ত মুহূর্তে কেন ‘কার্যকর’ গণতন্ত্রের কথা বলছেন সেটা মনোযোগের সঙ্গে খেয়াল করা আমাদের কর্তব্য।
যখন কথাটা বলছেন তখন সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে জাতিসংঘ থেকে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো যখন প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার জন্য ‘শান্তি মিশন’-এ বাংলাদেশে এসেছেন ঠিক তার আগের মুহূর্তে ‘সমঝোতা’র জন্য দলগুলোর ওপর নির্ভর না করে কিভাবে বিচার বিভাগকে সক্রিয় করা যায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে ভাবনা হতেই পারে। বিদ্যমান সংকট সমাধানের জন্য রাজনৈতিক ‘সমঝোতা’ ঘটাবার আন্তর্জাতিক দূতিয়ালি ব্যর্থ হতে পারে সেটা আগাম অনুমান করে অচলাবস্থা ভাঙবার আইনি পথ কী হতে পারে সেটা অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে আগেভাগেই বাতলে দেওয়া দোষের কিছু নয়। অর্থাৎ আলাপ-আলোচনা আপস-সমঝোতায় যদি সমাধান না হয় তাহলে বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা বহাল রাখবার জন্য কী ধরনের ‘আইনি’ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব সেই দিকটার আলোচনা হতেই পারে। আমি তাঁকে বুঝেছি।
সমাধান হিসাবে তিনি যা চাইছেন সেখানে নতুনত্ব কিছু নাই; ৭ তারিখ শুক্রবার স্বৈরাচার পতন দিবস উপলে গণফোরামের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আয়োজিত সমাবেশে ড. কামাল হোসেন ‘সরকারের প্রতি মুক্ত বিতর্কের আহ্বান’ জানিয়েছেন। সরকারকে বলেছেন, ‘সুষ্ঠু ও নিরপেভাবে দশম সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য আপনাদের করা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করতেই হবে। এর সপক্ষে যুক্তি রাখার জন্য মুক্ত বিতর্কে আসুন, আপনাদের পক্ষে সংবিধান দেখান, আইন দেখান, দেখবেন, আপনাদের যুক্তি টিকবে না’। অর্থাৎ উকিল হিসাবে তিনি প্রমাণ করে দেখাতে পারবেন আইন ও সংবিধানের দিক থেকে পঞ্চদশ সংশোধনী টেকে না। গণফোরামের প্লাটফর্ম থেকে কথাটা তাঁকে রাজনীতির ভাষায় বলতে হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করবার জন্য তিনি আদালতের শরণাপন্ন হবেন কি না।
তিনি লিখেছেন, “এটা প্রহসনমূলক এবং দুর্ভাগ্যজনক যে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল যারা ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সুবিধা পেয়ে সরকার গঠন করল, তারাই কিনা পঞ্চদশ সংশোধনী এনে নির্দলীয় সরকার সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বাতিল করে দিল। তারা যুক্তি দিল, সুপ্রিম কোর্ট ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। এটা পরিহাসের যে সংবিধান সংশোধনীর জন্য গঠিত একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অগ্রাহ্য করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হলো। অথচ এই বিশেষ কমিটি ২৯ মার্চ ২০১৩ তাদের সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রেখেছিল। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ভবিষ্যৎসাপেক্ষে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, দশম সংসদ (২০১৪ সালে অনুষ্ঠেয়) এবং একাদশ সংসদ নির্বাচন বাতিল করে দেওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় হতে পারে”।
পঞ্চদশ সংশোধনীর পক্ষে ক্ষমতাসীনদের যুক্তি হচ্ছে, অসাংবিধানিক হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে আদালত। তারা আদালতের নির্দেশ পালন করেছে মাত্র। কামাল হোসেনের কথা অনুযায়ী এটা পুরাপুরি ঠিক না। কারণ ২০১৪ সালের দশম ও একাদশ সংসদের নির্বাচন আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কিছু শর্তসাপেে হতে পারে, আদালত সে কথাও বলেছে। প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত হচ্ছে আদালতের কাছে নালিশ জানালে এর মীমাংসা হতে পারে।
কিন্তু আদালত তো স্বাধীন নয়, আদালত কি সে কাজ করবে? বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বিগ্নতা ও তৎপরতাকে যদি আমরা হিসাবের মধ্যে আনি তাহলে বলা যায়, এভাবে সমাধানের পে সমর্থন পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একে কার্যকর করবার জন্য কোন-না-কোন বলপ্রয়োগের শক্তির সমর্থনের প্রয়োজন হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলনের শক্তিও যথেষ্ট হবে না। যদি সেটা হোত তাহলে এত দিনে মতাসীনদের পতন ঘটত ও পরিস্থিতি বদলে যেত।
ডক্টর কামাল হোসেনের বক্তব্যকে তাহলে বুঝতে হবে এই বাড়তি শক্তির কথা মনে রেখে। সেই শক্তির গুণে আদালত যদি ‘নিরপে’ ভূমিকা পালন করেÑ অর্থাৎ মতাসীনদের প্রভাবমুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার পরিবেশ পায় তাহলে আদালতের মাধ্যমেই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হতে পারে। রাজনৈতিক ভাবে যদি বর্তমান সংকটের সমাধান না হয়Ñ অর্থাৎ অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সমঝোতা ও আপসের মাধ্যমে ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে বাড়তি শক্তির জোরে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে এর সমাধান করা যেতে পারে। ডক্টর কামাল হোসেনের কথার এটাই ‘কার্যকর’ ব্যাখ্যা। এই সম্ভাবনার অনুমান হচ্ছে জাতিসংঘ এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে এবং শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হবে না, পঞ্চদশ সংশোধনীর সেই সকল ধারাও বাতিল হবে যাতে সেনাবাহিনী এই পরিবর্তনে জাতিসংঘের ছায়ায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সেই দিকেই যদি পরিস্থিতি গড়ায় তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে দাঁড় করাবার চাপও ‘কার্যকর’ ভাবে প্রয়োগ করা যাবে।
দুই
প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্টই শেষ ভরসা’ ( ৯ ডিসেম্বর ২০১৩) এই শিরোনামে প্রকাশিত একটি লেখায় আইনি ও সাংবিধানিক ধারায় সমাধানের চিন্তার পইে কিছু বাড়তি যুক্তি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির এমন সাংবিধানিক মতা নাই যাতে প্রধানমন্ত্রীকে তিনি অপসারণ করতে পারেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা যদি সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে তাহলে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়াই রেওয়াজ; এরপর, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে কারো যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন পাবার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে আবার নির্বাচন করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংসদীয় সরকারব্যবস্থা আছে বলে দাবি করলেও, আসলে ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে কায়েম আছে সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র। এক দিক থেকে সেটা সামরিক স্বৈরতন্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর, কারণ তাকে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। যার কুফল আমরা দিনের পর দিন ভোগ করছি। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা অসম্ভব। কারণ ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সেটা কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু ব্রিটেনের সংসদীয় ব্যবস্থা নিয়ে কিথ সাহেবের (Arthur Berriedale Keith) পরিচিত কেতাব The Bristish Cabinet System 1830-1938 বইটির একটি সূত্রকে নজির ধরে প্রথম আলোর লেখায় দাবি করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে পারেন। বাংলাদেশ রাজতন্ত্র নয়, আর এটা ১৮৩৪ সালও নয়। রাজা চতুর্থ উইলিয়াম পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সেই সময় মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছিলেন। লেখাটিতে সেই উদাহরণ টেনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও সেটা করতে পারেন।
এই উদাহরণ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একদমই খাটে না। তা ছাড়া রাজার এভাবে মতা প্রয়োগ ছিল বিলাতের শেষ উদাহরণ। এ ধরনের ঘটনা আর ঘটে নি। ফলে বাংলাদেশে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যদি প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করেন তবে সেটা হবে অসাংবিধানিক কাজ। কিন্তু প্রথম আলো সুপ্রিম কোর্টকে সাথে নিয়ে সেই অসাংবিধানিক কাজ করবার জন্য রাষ্ট্রপতিকে কার্যত পরামর্শ দিচ্ছে।
এরপর ভারতের সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসুকে স্যা খাড়া করা হয়েছে। রাজনৈতিক পার্টির স্বার্থে নির্বাচনী ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটালে মন্ত্রিসভা বাতিল করবার মতাও বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির নাই। দুর্গাদাস বলেছেন, ‘ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি’তে সংসদে নির্বাচিত হলেও মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া যায়। সেই ‘ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি’ কী? সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়েই দুর্গাদাস নির্বাচনীব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের উদাহরণ দিয়েছেন। সেই পরিবর্তন ঘটানো হলে সেটা ‘অসাংবিধানিক আচরণ’ বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশে পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করাকে সেই কাজ বলে গণ্য করা হয়েছে। পাল্টা তর্ক করা যায় তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাই বরং ‘নির্বাচনীব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন’-এর উদাহরণ। বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচনের যে ব্যবস্থা ছিল তার খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে ত্রয়োদশ সংশোধনী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। যদি প্রথম আলোর যুক্তি ঠিক হয় তাহলে তার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে সেই সময়ের রাষ্ট্রপতির বরখাস্ত করা উচিত ছিল। তাই না?
এগুলো কূটতর্ক। নিজদের সুবিধামতো আইন ও সংবিধান ব্যাখ্যা। অথচ প্রথম আলোর লেখায় দাবি করা হয়েছে সংবিধান থেকে “নির্বাচনী ব্যবস্থা সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ছুড়ে ফেলার” জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ বর্তমান মন্ত্রিসভাকেও রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সহায়তা নিয়ে বরখাস্ত করতে পারেন।খুবই উর্বর চিন্তা!!!
এগুলো স্পষ্টতই এখনকার সংবিধানের মধ্যেই আছি ভান করে আইনি দিক থেকে রীতিমতো সংবিধান লঙ্ঘনের প্রস্তাব ছাড়া অন্য কিছু নয়। দৈনিক প্রথম আলো এ ব্যাপারে খুবই সচেতন। বলা হচ্ছে,
“রাষ্ট্রপতি যে মুহূর্তে মনে করবেন সংলাপ ও সমঝোতার পথ রুদ্ধ, সেই মুহূর্ত থেকে তিনি একটি অসাধারণ প্রতিকারের কথা ভাবতে পারেন। এই বিশেষ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির যে আছে তার একটা আলোচনা ও গ্রহণযোগ্যতা সমাজে এখনই সৃষ্টি হওয়া দরকার। এ েেত্র রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্টের কোনো ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ পদক্ষেপ যে স্বীকৃত সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষের বাইরের যেকোনো পদক্ষেপের চেয়ে উন্নত, সেটা আগে মানতে হবে।”
অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির এ ধরনের সিদ্ধান্ত হবে ‘অসাধারণ’ এবং এটা যে ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ হবে সেটা জেনেও আমাদের আগেই এই স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিকার মেনে নিতে হবে। রাষ্ট্রপতির এই ধরণের ‘বিশেষ ক্ষমতা’ বাংলাদেশের সংবিধানে নাই, বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনৈতিক চর্চার মধ্যেও তার কোনো নজির নাই। কিন্তু এই ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্টকে প্রথম আলো উৎসাহিত করছে। উৎসাহিত করছে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে অসাংবিধানিক কাজ করিয়ে নেবার পক্ষে সমাজে ‘গ্রহণযোগ্যতা’ তৈরির জন্য।
বর্তমান সংবিধানের মধ্যে আছি এই ভান বহাল রেখে অসাংবিধানিক কাজে প্রথম আলোর উৎসাহ বিপজ্জনক। তবে এ কাজে সফল হতে হলে বিদ্যমান মতা ও সংবিধানের বাইরে অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হবে। সেটা হতে পারে আন্দোলনের শক্তি, যারা মতাসীন সরকারকে উৎখাত করবার জন্য লড়ছে। প্রশ্ন হচ্ছে যদি আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় তাহলে বিদ্যমান সংবিধান রেখে দেবার কোনোই যৌক্তিকতা নাই। বরং বিজয়ীরা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়াই শুরু করবে। বিদ্যমান সংবিধান পরিণত হবে পুরানা ইতিহাসে। কিন্তু প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গণ-আন্দোলনকে ঘোর শত্রুজ্ঞান করে। গণ-অভ্যুত্থান তো দূরের কথা। এর বাইরে বিকল্প হচ্ছে সেনাবাহিনী। হয়তো সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক-এগারোর মতো প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের যোগাযোগ হয়েছে। কে জানে! সেনাবাহিনী যদি সত্যিই দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য ভূমিকা রাখতে চায় তাহলে বর্তমান সংবিধানের বোঝা মাথায় নিয়ে নিজেদের ফাঁদে ফেলবে কেন। বিদ্যমান সংবিধান স্থগিত নয়, বরং সে পরিস্থিতিতে তা ফেলে দিয়ে নতুন ভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের কাজে নামা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নাই। সেনাবাহিনীর জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে পঞ্চদশ সংশোধনী সংবলিত শেখ হাসিনার সংবিধানের ফাঁদে পা দেওয়া হবে ভয়ঙ্কর পিচ্ছিল ও বিপজ্জনক পথ। প্রথম আলো তো তাই চাইছে। বর্তমান সংবিধান বহাল রেখে, প্রধানমন্ত্রীকে অসাংবিধানিক ভাবেই সরানোর চেষ্টা, কিন্তু ভান করা যে এটা সংবিধানবিরোধী নয়। কারণ ইংরেজ সাহেব আর্থার বেরিডেল কিথের কেতাব অনুযায়ী আর ভারতের সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসুর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, প্রথম আলো ভুল ভাবে বোঝাতে চাইছে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করতে পারেন। এখন দরকার সুপ্রিম কোর্টের সহযোগিতা। এটা বিপজ্জনক, কারণ এ কাজের ওপর প্রথম আলো যে সাংবিধানিক মোড়ক চাপিয়ে দেওয়া দিচ্ছে, তা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আদালতে চ্যালেঞ্জ হলে টিকবে না। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী এই ধরনের কর্মের হোতা সকলকেই ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।
এটা পরিষ্কার দৈনিক প্রথম আলো-ডেইলি স্টার এক-এগারোর গণবিরোধী ও গণতন্ত্রবিরোধী ভূমিকা থেকে এখনো সরে আসে নি। তারা খালেদা জিয়াকে যেমন চায় না, তেমনি শেখ হাসিনাকেও চায় না। গণতন্ত্রে সেটা দোষের নয়। কিন্তু তাদের তারা অপসারণ করতে চায় বর্তমান সংবিধান লঙ্ঘন করে অসাংবিধানিক পন্থায়; বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে। এটাই দোষের। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এমন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রই তাদের দরকার। এই রাষ্ট্র তাদের দরকার বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ রার জন্য। অর্থাৎ ততটুকুই অসাংবিধানিক কাজ করতে তারা উৎসুক যতটুকু দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে খালাস করে দেওয়া যায়। এই কাজে এর আগে তারা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছে সংবিধানের খাঁচার মধ্যে শেকল দিয়ে বেঁধে; তাদের পছন্দের বেসামরিক সরকারের পাহারাদার হিসাবে। যেন তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে সৈনিক বা সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের ইচ্ছা ও আকাক্সার সঙ্গে একাত্ম হতে না পারে। সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে জনগণের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রের আমূল গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজে নয়। সহায়ক শক্তি হিসাবেও নয়। এর পরিণতিতে যে সরকার এসেছে তাদের কাছ থেকে প্রথম আঘাত এসেছে সেনাবাহিনীর ওপর। বিডিআর হত্যাকাণ্ড, সীমান্ত অরতি করা এবং বাংলাদেশকে দিল্লির উপনিবেশে পরিণত করা হয়েছে। এই পরিপ্রেেিত বাংলাদেশের গণশক্তির বিকাশ ও রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর নতুন করে গড়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই। নাগরিক কি সৈনিক সকলকেই দেশ রায় অকুতোভয় হতে হবে। বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে কোনো সমাধানই টিকবে না। বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে সেনাবাহিনীর প্রত্য বা পরো ভূমিকা সেনাবাহিনীর জন্য বিপজ্জনক ফাঁদ ছাড়া অন্য কিছু নয়। জনগণের ইচ্ছা, আকাক্সা ও সংকল্পের বাইরে কোনো চেষ্টাই বাংলাদেশে কাজ করবে না। সৈনিক ও সাধারণ নাগরিক সকলকেই তা উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের বরং উচিত কৃত্রিম বিভক্তি ও বিভাজন সৃষ্টি না করে সাধারণ জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা যেন তার নিজের স্বরূপে বাংলাদেশের বাস্তবতায় সুনির্দিষ্ট রূপ নিতে পারে, আন্দোলন সংগ্রামকে সেই অভিমুখগুলো দেখিয়ে দেওয়া। ধ্বংসের খাদে ধাবিত হবার হাত থেকে দেশ যেন রা পায়।
বাংলাদেশ লড়াইয়ের নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। সার্বভৌমত্ব- অর্থাৎ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বিশ্বসভায় টিকে থাকার লড়াই। এ এমন এক লড়াই যাকে আইন বা নীতিনৈতিকতার দোহাই দিয়ে নিরস্ত করা অসম্ভব। এ লড়াই সহজে শেষ হবার নয়। আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া যার কোনো বিকল্প নাই।
আমরা প্রথম আলোর রাজনীতির বিরোধী, কিন্তু আমরা তাদের শুভাকাক্সী। আশা করি তাঁরা আমাদের উৎকণ্ঠা আন্তরিক ভাবে উপলব্ধি করবেন। সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তার মধ্যে ঐক্য ছাড়া বর্তমান সংকট থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না। আমার আশা মাইনাস টু দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের পুরানা চিন্তা থেকে তাঁরা বেরিয়ে আসবেন। জনগণের ওপর আস্থা রাখবেন। বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তরই যে একমাত্র ও সঠিক পথ সেই উপলব্ধির ভিত্তিতে সমাজে জনগণকে সচেতন করবেন, যাতে বর্তমান পরিস্থিতি একটা- ইতিবাচক পরিণতির দিকে যেতে পারে।
১০ ডিসেম্বর ২০১৩। ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪২০। আরশিনগর।