প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বুঝতে হবে উল্টো করে
সিরাজুর রহমান:
খবর আতঙ্কে পুলিশ। অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যরাও এখন চরম আতঙ্কের মধ্যে আছেন। জেলার পুলিশ সদস্যদেরও মনোবল আগের মতো চাঙ্গা নেই। খবর- ত্রিশজন জেলা প্রশাসক (ডিসি) বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা চেয়ে ক্যাবিনেট সেক্রেটারিকে চিঠি লিখেছেন। কিছু দিন আগের খবরÑ বড় আকারের দলেবলে ছাড়া পুলিশ মফস্বলে যেতে সাহস পায় না।
খবরগুলো মঙ্গল কিংবা অন্য কোনো গ্রহের নয়। আজকের বাংলাদেশের। নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের ওপর, তারা কেমন অসহায় বোধ করছেন ওপরের খবর তিনটি থেকে তার সম্যক চিত্র পাওয়া গেল। কেন এমন হলো? সরকার তো নিজেদের ভোটব্যাংকের সদস্যদের দিয়ে প্রশাসন দলীয়ভাবে ঢেলে সাজিয়েছিল, বেছে বেছে দলীয় সমর্থকদের দিয়ে পুলিশবাহিনীর কলেবর কয়েক গুণ বাড়িয়েছিল। তা সত্ত্বেও এমন অবস্থা কেন হলো? কারণটা প্রশ্নের মধ্যেই পাওয়া যাবে। একটু খতিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, ভূতগুলো সরষের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল।
সরকার সম্পূর্ণ দলীয়কৃত প্রশাসন ও পুলিশবাহিনী গড়ে তুলেছিল এ আশায় যে, যখন তাদের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে এই প্রশাসন আর এই পুলিশরাই অবৈধ উপায়ে হলেও গদি আঁকড়ে থাকতে সরকারকে সাহায্য করবে। সেটা তারা করে আসছে এবং অতি উৎসাহীভাবেই করে এসেছে। এত উৎসাহের সাথে করেছে যে, দেশের মানুষের সেটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে অনেক দিন আগে থেকেই। প্রশাসন, পুলিশ আর দলীয়কৃত র্যাবকে বাংলাদেশের মানুষ এখন শত্রুপক্ষ মনে করে। অনেক গুলি আর মার খেয়ে তারা এখন রুখে দাঁড়িয়েছে, প্রতিরোধ করছে। এই সরকার মানুষের সমর্থনে আর দেশবাসীর ভোটের জোরে নয়, র্যাব-পুলিশ আর নিজেদের সশস্ত্র ক্যাডারের জোরে গদি দখল করে থাকতে পারবে ভেবেছিল। হাতিয়ারগুলোই এখন ভয়ে মুখ লুকোচ্ছে। সরকার এখন কী করবে?
এখন প্রায়ই বিজিবিকে (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) তলব করছে সরকার। আপনাদের মনে থাকার কথা, প্রায় পাঁচ বছর আগে এখনো রহস্যেঘেরা বিডিআর বিদ্রোহের পরে সেই বাহিনীকে ভেঙে দিয়ে সরকার ১৯৭১ সালে তাজউদ্দীন আহমদের সাথে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের সাত দফা চুক্তির একটা দফা পালন করেছে। সে দফা এই ছিল যে, স্বাধীন হলে বাংলাদেশ বিডিআর বাহিনীকে ভেঙে দিয়ে ভারতের বিএসএফের (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) তত্ত্বাবধানে একটা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বাহিনী গঠন করবে। কারণগুলোও আপনাদের জানা থাকার কথা। বিডিআর আমাদের সীমান্তে বিএসএফ কিংবা ভারতীয় নাগরিকদের অনুপ্রবেশ বরদাশত করেনি, সীমান্তে বাংলাদেশীদের ওপর জুলুম-অত্যাচারও সহ্য করেনি। এরা সর্বশক্তি দিয়ে দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ ছিল। দিল্লির সরকার কখনোই বিডিআরের ওপর প্রসন্ন ছিল না। এখন দিল্লির হুকুমে আওয়ামী সরকার ৪২ বছর আগের সাত দফা চুক্তি পালন করছে, যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নিতে ভারতকে বাধ্য করেছিল।
বর্তমান সরকার তাদের প্রশাসন পুলিশ আর র্যাবের মতো বিজিবিতেও বেছে বেছে আওয়ামীপন্থীদেরই নিয়োগ করেছিল। সরকার পুরাকাহিনীর সাদ্দাদের মতো আশা করেছিল মনমতো লোকেদের দিয়ে নিরাপত্তাবাহিনীগুলো গঠন করা হলে তাদের গদি নিরাপদ হবে। একটা কথা তারা ভুলে গিয়েছিল। এই লোকগুলো আওয়ামীপন্থী হলেও এরা বাংলাদেশেরই লোক এবং তাদের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। দেশের মানুষ তাদের পরিচয় জানে এবং দেশের মানুষ এখন অত্যাচারী পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির ওপর ভয়ানক ক্রুদ্ধ। নিরাপত্তাবাহিনীগুলোর সদস্যদের ক্রমবর্ধমান শঙ্কার এটাও একটা কারণ।
সেনারা নানা কারণে হুঁশিয়ার হচ্ছে
সরকার এখন সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অর্থাৎ তাদের বাঁচানোর কাজে নামানোর চেষ্টা করছে। এরা সেনাবাহিনীর পাহারায় ভোটারবিহীন নির্বাচন করে বাকশালী স্বৈরতন্ত্র কায়েম করার আশায় আছে। সেনাবাহিনীর জওয়ানরাও র্যাব-পুলিশ আর বিজিবির সদস্যদের মতোই গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের সন্তান। উপরোল্লিখিত তিনটি বাহিনীর সদস্যদের মতো এরাও মফস্বলের পরিবার-পরিজনদের নিরাপত্তার কথা ভেবে শঙ্কিত। আরো একটা ভয়ের কারণ আছে তাদের। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেনাবাহিনীতে লোকে যোগ দিয়েছে বিশেষ করে এ আশায় যে, জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসেবে তারা বিদেশে যাবে, ইউএন ডলার রোজগার করবে এবং নিজের ভাগ্য ফেরাবে। জাতিসঙ্ঘের দিক থেকে এখন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, বর্তমান সরকার যদি একগুঁয়েমির বাড়াবাড়ি করে তাহলে বিদেশে শান্তিমিশনগুলোতে নিয়োগ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাদ পড়তে পারে।
এ দিকে বাংলাদেশে মানুষ মারা যাচ্ছে, ঘরবাড়ি যানবাহন পুড়ছে, অর্থনীতির বারোটা বেজে গেছে, সতেরোটা বাজি বাজি করছে। সরকারের হাতে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র এবং দলের অনুগত মিডিয়া আছে, আছেন গলাবাজ মন্ত্রী ও অন্য নেতারা। এরা বোকা মনে করে সমর্থক ও বিদেশীদের চোখে ধুলো দেয়ার চেষ্টা করছেন এই বলে যে, বিএনপি এবং ১৮ দলের জোট গণতন্ত্রের নামে হত্যাতন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
সরকার যখন বিএনপির দুর্নীতির জিগির তোলেন তখন বুঝতে হবে যে তারা পদ্মা সেতু দুর্নীতি, হলমার্ক দুর্নীতি, কুইক রেন্টাল দুর্নীতি, শেয়ারবাজার লুণ্ঠন ইত্যাদি দুঃসংবাদ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও খুন, ক্যাডারদের হত্যালীলা ইত্যাদির প্রসঙ্গ মিডিয়ায় জোরালো হয়ে উঠলে সরকারি দলের নেতারা জিয়া পরিবারকে খুনি বলে গালাগাল শুরু করে দেন।
সরকার বলছে বিএনপি ক্ষমতার জন্যে উন্মাদ হয়ে গেছে। প্রকৃত পরিস্থিতি হচ্ছে গদি আঁকড়ে থাকার জন্য এ সরকারের উন্মাদ চেষ্টার নিন্দা এখন দেশে তো বটেই, সারা বিশ্বেই ধ্বনিত হচ্ছে। তাদের এই গদিলিপ্সা এ যাবৎ কয়েক শ’ মানুষের মৃত্যুর কারণ ঘটিয়েছে। একটি মানুষের অপমৃত্যুও গোটা মানবসমাজের অপমৃত্যুর মতোই নিন্দনীয়। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গান করে। দেশের মানুষ এখন যুদ্ধ করছে গণতন্ত্রকে বাঁচাবে বলে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে গণতন্ত্রের হত্যা শুরু হয়েছে। তারা জানে তাদের ভোটব্যাংক ছাড়া আর কেউ তাদের ভোট দেবে না।
ভোট ব্যাংকেও এখন অবক্ষয় শুরু হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে শোনা যাচ্ছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তানেরা হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করে নিচ্ছে, হিন্দু নারী ধর্ষণ করছে। এ খবর আমি ২০০৯ সালেই শুনেছি সরকারের একজন সংখ্যালঘু মন্ত্রী শত শত একর অর্পিত হিন্দু সম্পত্তি দখল করে নিয়েছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চট্টগ্রামের রামুসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ চাঁদাবাজি করেছে। চাঁদা না পেলে তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে ও পুড়িয়ে ফেলছে, হিন্দু মন্দিরের দেবমূর্তি ভাঙচুর করছে। রামুসহ কোনো কোনো স্থানে সরকার গোড়ায় বিএনপি ও জামায়াতের ওপর দোষারোপ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রমাণ পাওয়া গেছে শাসক দলের লেজুড়দের বিরুদ্ধে। কথায় বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।
সহিংসতা ঘটাচ্ছে সরকার, তারাই মানুষ মারছে
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলের জোট আন্দোলন। এখন একটা গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। সরকার ঢাক পেটাচ্ছে এই বলে যে, আন্দোলনে মানুষ মারা যাচ্ছে, যানবাহন ভাঙচুর হচ্ছে। একটু খতিয়ে দেখলেই আসল সত্যটা বেরিয়ে আসবে। গত শনিবার বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে দেয়নি সরকার। কিন্তু তার আগে যে সমাবেশ করেছে বিএনপি, তাতে কোনো বিশৃঙ্খলা কিংবা সহিংসতা ঘটেনি। বিরোধী পক্ষ কোনো কর্মসূচি দিলেই সরকার পুলিশ ও র্যাবের সংরক্ষণে আওয়ামী ক্যাডারদের পাঠাচ্ছে বিরোধীদের কর্মসূচি ভণ্ডুল করার ব্যর্থ আশায়।
আগ্নেয় অস্ত্রসহ নানা রকম অস্ত্র হাতে আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের ছবি সরকারের সমর্থক মিডিয়াতেও প্রকাশিত হচ্ছে। মিডিয়ায় প্রায়ই দেখা যাচ্ছে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বিরোধীদলীয় কর্মীদের মতো আওয়ামী লীগের কর্মীরাও মারা যাচ্ছে। তারা যে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বাধা দিতে গিয়েছিল এসব হচ্ছে তার প্রমাণ। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করা নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। সরকার সে অধিকার অস্ত্রবলে দলন করছে। অর্থাৎ সহিংসতার উসকানি দিয়ে সেসব কর্মসূচিতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করাচ্ছে সরকার। জনতার প্রতিবাদ এখন খরস্রোতা নদীর মতো। সে স্রোতকে বাধা দিতে গেলে বিপর্যয় ঘটবেই।
গত ২৫ নভেম্বর দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের বিরুদ্ধে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। সেটা যে গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বালানোর নামান্তর ছিল তাতে কারো সন্দেহ ছিল না। প্রতিবাদে বিএনপি ও ১৮ দলের জোট দেশজোড়া অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এক ডজনেরও বেশি মানুষ তাতে মারা গেছে। তাতে আমরা শোকাহত, মর্মাহত।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে আওয়ামী লীগ-জামায়াতের লাগাতার হরতালেও মোটামুটি এ রকম সংখ্যার মানুষ খুন হয়েছে। সড়ক সেতু, রেল ও নৌযান চলাচল তখনো এবং ২০০৬ সালে হাসিনার লগি-লাঠি-বৈঠার লাগাতার হরতালেও বন্ধ করা হয়েছিল। সে দুই আন্দোলনেও বহু স্থানে রেললাইন উপড়ানো এবং ফিশপ্লেটে আগুন লাগানো হয়েছিল। শেখ হাসিনা কি তখন সেসবের প্রতিবাদ করেছিলেন?
শাহবাগে বাসে কে আগুন লাগিয়েছিল?
শাহবাগে একটি বাসে আগুন লাগানোর দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। শুনেছি চারজন মানুষ মারা গেছে তাতে এবং আরো ১৩-১৪ জন হাসপাতালে আছেন। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে প্রধানমন্ত্রী, অন্য মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ ভিআইপিদের ভিড়ে আহতদের চিকিৎসায় রীতিমতো বিঘœ ঘটছে। ভিআইপিদের এসব হাসপাতাল ‘ভিজিট’ যে লোকদেখানো এবং প্রচারণার কৌশল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গোড়া থেকেই এ সরকার গোয়েবলসীয় প্রচারকৌশলের জোরে গদিতে টিকে থাকার চেষ্টা করে আসছে। বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা বারবার এবং জোরগলায় এ ঘটনার দায়িত্ব অস্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন যে, সরকারের এজেন্টরাই ওই বাসে আগুন লাগিয়েছিল।
সে কথা বিশ্বাস করারও প্রাসঙ্গিক কারণ আছে। বাসে আগুন লাগিয়ে যাত্রীদের পুড়িয়ে মারার নজির আওয়ামী লীগ আগে থেকেই সৃষ্টি করে রেখেছে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতির দাবিতে আন্দোলনের সময় এই শাহবাগেই আওয়ামী লীগের কর্মীরা একটি বাসে আগুন লাগিয়ে ৯ যাত্রীকে পুড়িয়ে মেরেছিল। শাহবাগ আওয়ামী লীগের পেশিশক্তির আধিপত্যের জন্য কুখ্যাত। কয়েক শ’ আওয়ামীপন্থী ও ইসলামবিরোধী দুই মাস ধরে এই শাহবাগে হেন মঞ্চ তেন মঞ্চ নামে গেড়ে থেকেছিল। আলোচ্য বাসের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগের লোকেদের কথা প্রথমেই মনে আসে। তা ছাড়া মাত্র কয়েক দিন আগে দৈনিক নিউ এজের সম্মানীত সম্পাদক নূরুল কবীর দাবি করেছেন, সরকারের লোকেরাই বিআরটিসি বাসে আগুন লাগাচ্ছে বলে তার কাছে প্রমাণ আছে।
তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রচার চালাচ্ছেন এই বলে যে, খালেদা জিয়া গণহত্যা শুরু করেছেন। সরকারপক্ষকে মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন, আড়াই শ’ বিচারবহির্ভূত হত্যা, ২০০ গুম-খুন, ইলিয়াস আলীকে ছিনতাই এবং ২৬ মে অতি ভোরে শাপলা চত্বরে লাখ লাখ ঘুমন্ত মানুষের ওপর পাইকারি গুলিবর্ষণের অভিযোগ আছে এ সরকারের বিরুদ্ধে। এসব ক্ষেত্রে হুকুমের আসামি কে, তা বাংলাদেশের মানুষকে বলে দিতে হবে না। সত্যি কথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হজম করতে পারেন না। শাপলা চত্বরের গণহত্যায় নিহত ৬১ জনের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেছিল মানবাধিকার সংস্থা অধিকার। বিশ্বজোড়া সম্মানিত অধিকার সংস্থার দু’জন প্রধান কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে প্রধানমন্ত্রী গায়ের ঝাল মিটিয়েছিলেন।
বৃহত্তর বিপদ সৃষ্টি করছে সরকারই
বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার লঙ্ঘন করে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সভা-সমাবেশ-মিছিল করার অধিকার অপহরণ করেছেন। সারা দেশের মানুষের দাবি অগ্রাহ্য করে এ সরকার পুরনো মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী একদলীয় নির্বাচন করতে উদ্যত হয়েছে। বিরোধী দল ও জোটের প্রতিবাদ নিস্তব্ধ করার আশায় সরকার পাইকারিভাবে বিএনপির নেতাদের গ্রেফতার করেছে এবং করছে। পাইকারিভাবেই তাদের সবার বিরুদ্ধে ‘গাড়ি ভাঙচুর করার এবং ককটেল বোমা নিক্ষেপের’ অভিযোগ আনা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং পাগল ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করবে না যে, সম্মানিত ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতারা এসব দুষ্কর্ম করতে পারেন। কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতার, বিশেষ করে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের উক্তি থেকেও প্রমাণ হয় যে, সরকারের অভিযোগগুলো পুরোপুরি মিথ্যা এবং রাজনৈতিক মতলবে আবিষ্কার করা হয়েছে। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে রাজি হলে বন্দী সব নেতাকে মুক্তি দেয়া হবে।
সরকারের এই অপকর্মের দূরমেয়াদি কুফল উপলব্ধি করার মতো দূরদৃষ্টি বোধ হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেই। সারা দেশের মানুষ এখন সরকারের অন্যায়-অবিচার-দুর্নীতি এবং বাকশালী ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে। নেতাদের গ্রেফতার কি তাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে এতটুকু তারতম্য ঘটিয়েছে? ২৫ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীবউদ্দিন আহমদের বেতারভাষণের প্রতিক্রিয়ায় অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা বিএনপির নেতারা দিয়েছিলেন রাত ৯টার দিকে। কিন্তু দেশের সব অঞ্চলের সাধারণ মানুষ তার এক ঘণ্টা আগেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে। অর্থাৎ আন্দোলন, কর্মসূচি ও অবরোধ এখন তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হাতে চলে গেছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলে পুরে রেখে সরকারের কোনো লাভের আশা নেই। কিন্তু যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, হরতাল, অবরোধ ও কর্মসূচি গুটিয়ে আনার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে সে আহ্বান দেবে কে? সরকারের নির্দেশে তারা থেমে যাবে না। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবে তারা।
প্রধানমন্ত্রীর অবাস্তব ও অন্যায় উচ্চাভিলাষের কারণে বাংলাদেশ কোথায় নেমে এসেছে সবাই জানে। দুর্ভাগ্যবশত তার দুর্দম একগুঁয়েমিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। তারা মুখে বাংলাদেশের মানুষের সাথে বন্ধুত্বের কথা বলে; কাজে কিন্তু তারা একজন স্বৈরতন্ত্রী ও গণবিদ্বেষী ব্যক্তিকে এ দেশের মানুষের ঘাড়ের ওপর স্থায়ীভাবে বসিয়ে রাখতে চায়? কেন? কারণটা কারোই অজানা নয়। হাসিনার সাথে গোপন চুক্তি করে ভারত বাংলাদেশের রেল, সড়ক, নদীপথ ও সমুদ্রবন্দরগুলো অবাধ ব্যবহারের অনুমতি আদায় করে নিয়েছে, যদিও ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত সীমান্ত সহজীকরণ চুক্তি তারা অনুমোদন করেনি, আজো তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে সই করেনি। কিন্তু ভারতের চূড়ান্ত লক্ষ্য বাংলাদেশকে পুরোপুরি ভারতের অঙ্গীভূত করে নেয়া। অভিন্ন মুদ্রার প্রস্তাব দিয়ে বর্তমান সরকার ভারতকে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এরা দিল্লির হুকুম তামিল করতে সদাপ্রস্তুত। দ্বিতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনাকে গদিতে বসিয়ে বাংলাদেশকে গ্রাস করে নেয়ার কাজও ভারত সেরে নিতে চায়। কেননা হাসিনা ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশী এ দেশটাকে ওই দেশের হাতে তুলে দিতে রাজি হবেন না।
পঙ্কজ শরণের ভূমিকা এবং সুজাতার সফর
ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তার হস্তক্ষেপ অনেকেই আপত্তিকর মনে করছেন। কেউ কেউ তাকে ব্রিটিশ আমলের ভাইসরয়ের সাথে তুলনা করেছেন। গোপনে ক্ষমতাসীনদের সাথে তার বৈঠককে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখছেন। মনে হচ্ছে, এখন ‘একা রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব দোসর’ অবস্থা হচ্ছে। পঙ্কজ শরণের ‘বস’ পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের ঢাকা সফরের উদ্দেশ্য আমাদের জানার কথা নয়, কিন্তু তার ও তার বাবার অতীত কীর্তিকলাপ কিছুটা শঙ্কার কারণ ঘটায় বৈকি!
তার বাবা টি ভি রাজেশ্বর ভারতের অভ্যন্তরীণ ইন্টেলিজেন্স বিভাগের প্রধান ছিলেন। সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার ষড়যন্ত্রে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। রাজেশ্বরের মেয়ে সুজাতা সিং র-এর ঢাকা সফর অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ভারত যখন পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম সংগ্রহে অনিচ্ছুক অস্ট্রেলিয়াকে সাধ্যসাধনা করছিল, তখন সুজাতাকে হাইকমিশনার করে অস্ট্রেলিয়া পাঠানো হয়। বলা হয় সে দেশে প্রবাসী ভারতীয়দের উসকানি দিয়ে তিনি যেন একটা দাঙ্গা বাধান এবং সে দেশের সরকারকে বর্ণবাদের দায়ে অভিযুক্ত করেন। এভাবে চাপ সৃষ্টি করে তিনি ভারতকে ইউরেনিয়াম বিক্রির চুক্তি করতে সে দেশের লেবার দলীয় সরকারকে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
লন্ডন, ০৩.১২.১৩
বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান