‘আমার আত্মা কিয়ামত পর্যন্ত কাঁদবে : কাদের মোল্লা আর কসাই কাদের এক ব্যক্তি নয়’
গোলাম মাওলা রনি:
ছোট্ট একটি ব্যক্তিগত দায় থেকে আজকের লেখাটির অবতারণা। কাসিমপুর জেল থেকে মুক্তির দিন সকালেই ঘটলো ঘটনাটি। মুক্তি লাভের আশা আর জেল গেটে পুনরায় গ্রেফতার হবার আশংকার দোলা চলে দুলতে দুলতে আমি আমার মালপত্র গুছাচ্ছিলাম। এমন সময় লুঙ্গি পরা এক ব্যক্তি আমার রুমে ঢুকে সালাম দিলো এবং বললো- কাদের মোল্লা সাহেব আপনাকে একটি চিঠি দিয়েছেন। মুহুর্তের মধ্যে আমি কিং কর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। সিদ্বান্ত নিতে পারছিলাম না, চিঠিটি কি গ্রহণ করবো না ফেরত পাঠাবো। এরই মধ্যে আগন্তক টেবিলের ওপর চিঠিটি রেখে তড়িৎ গতিতে চলে গেলেন। আমি কম্পিত হস্তে চিঠিটি খুললাম। একটি ছেড়া ছোট কাগজে ৩/৪টি বাক্য লিখেছেন কাদের মোল্লা। কিন্তু বাক্যগুলোর তীর্যক অভিব্যক্তি আমাকে যারপরনাই আহত করলো। সেই চিরকুটের ইতি কথা বলার পূর্বে আরো কিছু প্রসঙ্গ পাঠকগণকে জানাতে চাই-
কাসিমপুর জেলে ঢোকার পর পরই আমার জেলমেটগণের নিকট কাদের মোল্লার সম্পর্কে বহু কথা শুনছিলাম হররোজ। বিশেষ করে খাবার টেবিলে তার সম্পর্কে আলোচনা হতো সব চেয়ে বেশি। ট্রাইব্যুনালের রায়ে দোষী সাবস্ত হবার পূর্বে ডিভিশন প্রাপ্ত বন্দী হিসেবে সুরমা সেলেই ছিলেন। ডায়াবেটিসের রুগি। খাবার টেবিলে বসে প্রথমেই বলতেন কিছুই খাবেন না। তার পর একটার পর একটা খাবারের দিকে তাকাতেন। শিশুর মতো হাসি দিয়ে বলতেন মামুন- গোস্তের রংটা বোধ হয় ভালই হয়েছে। তার পর মাহমুদুর রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলতেন ঘ্রানটাও তো চমৎকার। মীর কাসিম বা অন্য বন্দীদের দিকে তাকিয়ে এমন ভাব করতেন যেন কাদের মোল্লা সাহেবকে খাওয়ার জন্য একটু অনুরোধ করেন। এক সময় তিনি অনুরোধে সাড়া দিয়ে খাওয়া শুরু করতেন এবং হই-হল্লোড়, হাসি- তামাসা এবং নানা রকম গল্প উপাখ্যান বলে পুরো খাবার টেবিল মাতিয়ে রাখতেন। বিষন্ন বন্দীরা তাই কাদের মোল্লার উপস্থিতিটাকে এক ধরনের প্রশান্তি হিসেবে গণ্য করতো।
অমি যখন জেলে ছিলাম তখন কাদের মোল্লা ছিলেন অন্য সেলে সাধারণ বন্দীদের মতো। যুদ্ধাপরাধের সাজাপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে তার প্রতি ছিলো জেল কর্তৃপক্ষের সতর্ক প্রহরা। ফলে প্রতি বিকেলে পাশাপাশি সেলের বন্দীরা নিজেদের সীমানা প্রাচীরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বার্তা বলার চেষ্টা করতো আবার পুরোনো বন্দীদের কেউ কেউ রাস্তায়ও বের হয়ে আসতো। কিন্তু কাদের মোল্লাকে সেই সূযোগ দেয়া হতো না। কাদের মোল্লার সেবক সকাল বিকালে আমাদের সেলে আসতো ফ্রিজ থেকে ইনসুলিন নেবার জন্য। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কে বা কারা যেনো সুরমা সেলে ছোট্ট একটি ফ্রিজ বসিয়েছিলো কেবল মাত্র কাদের মোল্লার ওষুধ পত্র রাখার জন্য। সেই ফ্রিজে কাদের মোল্লার ডায়াবেটিসের ওষুধ পত্র থাকতো। সেবক যখন ওষুধ নিতে আসতো তখন তার নিকট থেকে কাদের মোল্লা সম্পর্কে টুকটাক জানতে পারতাম।
বন্দী জীবনের নিরন্তর সময় যেনো আর কাটতে চাইতো না। ফলে আমরা সময় টুকুকে যথাসম্ভব আনন্দ মূখর করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতাম। যার যতো জ্ঞান বা প্রতিভা ছিলো- সবই উজার করে দিতাম সহযাত্রীদেরকে আনন্দ দেবার জন্য। একদিন বিকেলে বসেছিলাম সুরমা সেলের বারান্দায়। পাশাপাশি চেয়ার নিয়ে আমরা সবাই- গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, মাহামুদু রহমান, মীর কাসিম আলী আর এটিএম আজাহার। হঠাৎ নীরব হয়ে গেলাম অজানা কারণে। অর্থ্যাৎ বলার মতো কোন কথা ছিলো না কারো মূখে। হঠাৎ মামুনই বলে উঠলো- এই সময় মোল্লা ভাই থাকলে আমাদের সবাইকে গান শোনাতেন। জামাতের লোক আবার গান গায় নাকি- মনে মনে টিটকারী কেটে জিজ্ঞাসা করলাম- কি গান গাইতেন? রবীন্দও সঙ্গীত- অসাধারণ তার গায়কী গলা আর সুরের ঢং- মাহমুদুর রহমান বললেন।
আমি নিজে টুকটাক গাইতে জানি। তাই প্রস্তাব করলাম কিছু একটা গাওয়ার জন্য। তারা আগ্রহ দেখালে আমি একটি গ্রহন্দ্র সঙ্গীত গাইলাম- ‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে’। সবাই শুনলেন এবং প্রশংসা করলেন। তবে একথা বললেন যে, আমার চেয়েও কাদের মোল্লা সুন্দর করে গান করেন। তার গান পরিবেশনের সময় তিনি উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে এমনভাবে চোখের ভাব বিনিময় করেন যে শ্রোতাগণ তার সঙ্গে গুণগুনিয়ে কন্ঠ মেলাতে বাধ্য হন। ফলে পুরো অনুষ্ঠান হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। অন্যদিকে আমি গান করি চোখ বুঝে। যখন আমার সঙ্গী-সাথীগণ যখন আমাকে চোখ খোলা রেখে আরো একটি গান গাইতে অনুরোধ করলেন তখন আমি ভারী লজ্বা পেয়ে গেলাম এবং আর এগুতো পারলাম না। ফলে তারা আবার পুনরায় কাদের মোল্লার প্রশংসা করতে থাকলেন।
একদিন আমরা সকলে খাবার টেবিলে বসে দুপুরের খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সেবকরা তখন খাবার পরিবেশনের জন্য এঞ্জাম করছিল। এমন সময় কাদের মোল্লার সেবক এসে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের নিকট ছোট একটি চিঠি ধরিয়ে দিল। চিঠিটি পড়ার পর মামুনের মূখমন্ডল ক্ষোভ, লজ্বা আর রাগে লাল হয়ে গেল। এরপর সে চিঠিটি মীর কাসেম আলীর হাতে দিল। কাসেম সাহেব চিঠিটি পড়ে কাদঁতে আরম্ভ করলেন। আমার হাতে যখন চিঠিটি এলো তখন দেখলাম কাদের মোল্লা লিখেছেন-
প্রিয় মামুন,
সালাম। নিতান্ত বাধ্য হয়েই তোমার সেবক মতির বিরুদ্ধে তোমার নিকট নালিশ জানালাম। ইদানিং কোনো জানি আমার বেশি বেশি ডাল আর উস্তা ভাজি খেতে ইচ্ছে করে। আমার নিজের অর্থ দিয়ে এসব কিনে খাওয়া যে সম্ভব নয় তা তুমি জানো। তুমি আমার জন্য এ যাবৎ অনেক কিছু করেছ- আর তাই তোমার উপর অজানা এক অধিকার জন্ম নিয়েছে। সেই অধিকার বলে আমার সেবককে বলেছিলাম চোখায় (রান্না ঘরে) যখন খাবার ভাগাভাগি হয় তখন মামুনদের ভাগ থেকে একটু ডাল আর উস্তাভাজি বেশি করে নিও আমার জন্য। কিন্তু তোমার সেবক আমাকে এই সুযোগ দেয়নি। জীবন-মৃত্যুর শেষপ্রান্তে দাড়িয়ে এই অভাগা তার ছোট ভাইয়ের নিকট একটু ডাল আর উস্তাভাজি চেয়ে যদি অন্যায় করে থাকি তবে মাফ করে দিয়ো। ইতি-
চিঠি পড়ে আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মাহমুদুর রহমান সাহেব বললেন- কাল থেকে মোল্লা সাহেবের জন্য আলাদা ডাল আর উস্তাভাজি রান্না হবে। সব বিল আমি দেব। মামুন ক্রোধে কাঁপছিল আর সেবককে শাসাচ্ছিল। আর অন্যরা একধরনের বিষন্নতার নষ্টালজিয়ায় ভুগতে লাগলাম।
এবার আমি বলছি- আমার কাছে লিখা কাদের মোল্লার চিরকুট কাহিনী। তিনি লিখেছেন-
প্রিয় রনি,
যদি কখনও সময় পাও এবং তোমার ইচ্ছা হয় তবে আমার ফাঁসির পর একবার হলেও বলো বা লিখো- কাদের মোল্লা আর কসাই কাদের এক ব্যক্তি নয়। আমার আত্মা কিয়ামত পর্যন্ত কাঁদবে আর কসাই কাদের তখন কিয়ামত পর্যন্ত অট্টহাসি দিবে।
সূত্র: ফেসবুক স্ট্যাটাস